মনিং সিকনেস এর কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা

মা হওয়ার আগে মনিং সিকনেস বা সকালের অসুস্থতার কবলে পড়তে হয়। মা হওয়া সহজ বিষয় না। গর্ভাবস্থায় নানা শারীরিক জটিলতার মধ্যে যেতে হয় প্রত্যেক মাকে। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, ক্ষুধা কমে যাওয়া, পেশিতে ব্যথা -এমন নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় অন্তঃসত্তা নারীর।

কারও কম, কারও ক্ষেত্রে বেশি। মাতৃগর্ভে ভ্রূণের সঞ্চার হওয়ার পর থেকেই সব নারীই নানা শারীরিক অস্বস্তি অনুভব করেন। সন্তান পৃথিবীর আলো না দেখার আগ পর্যন্ত এসব নানান শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নারীকে।

মনিং সিকনেস অন্তঃসত্তাকালীন স্বাভাবিক ঘটনা:

সম্প্রতি অন্তঃসত্ত্বাকালীন এই শারীরিক জটিলতা মনিং সিকনেস এর অন্যতম একটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন স্বাস্থ্য গবেষকরা। নতুন গবেষণা জানাচ্ছে,গর্ভের সন্তান ‘হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারাম’ নামে এক ধরনের হরমোন তৈরি করে। এই হরমোন ক্ষরণের কারণে গর্ভবতী নারীরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন।

অন্তঃসত্ত্বা নারীর মাথা ঘোরা, বমির মতো শারীরিক সমস্যা কেন হয় তার উৎস বের করেছেন গবেষকরা

গবেষকরা বলছেন, সকলের এই হরমোনের কারণেই শরীর খারাপ হয়, তা একেবারেই না। কারণ, সকলের এই হরমোন ক্ষরণ হয় না। ১০০ জন অন্ত্বঃসত্ত্বার মধ্যে ১-৩ জনের এমন হতে পারে।

এই হরমোন ক্ষরণের উপর নির্ভর করছে গর্ভাবস্থায় শরীরের অবস্থা কেমন থাকবে। হরমোন ক্ষরণ হচ্ছে মানেই যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বে, এমন নয়। অনেক সময়ে হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারাম বা এইচজি হরমোন কম ক্ষরণ হলেও খুব বেশি সমস্যা হয় না।

তবে বেশি ক্ষরণ হলে স্বাভাবিকভাবেই শরীরের উপর তার নেতিভাচক প্রভাব পড়বে তার মধ্যে মনিং সিকনেস একটি। এমন তথ্যই উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষনায়।

মনিং সিকনেস এর কারণ কি?

মনিং সিকনেস বা সকালের অসুস্থতা গর্ভবতী নারীদের বেলায় একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এর বাইরে গর্ভাবস্থায় অস্বাভাবিক ঘটনা হচ্ছে বমি বমি ভাব অনুভব করা বা বমি করা। অতিরিক্ত বমি বমি ভাব বা বমি করায় গর্ভবতী নারীরা গুরুতর অসুস্থ অথবা দুর্বল হয়ে পড়েন। নতুন এক গবেষণায় এটির সম্ভাব্য উৎস বের করেছেন বিজ্ঞানীরা।

গবেষণা অনুসারে জিডিএফ-১৫ (GDF-15) হরমোন হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারামের জন্য দায়ী

গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে ৮৫ শতাংশ নারীর মধ্যে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি করার উপসর্গ পাওয়া যায়। এই উপসর্গটি প্রায়শই সকালে অসুস্থতা (EG) বলা হয়। যদি সকালে অসুস্থতা বেশি গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে এইটিকে হাইপারমমেসিস গ্র্যাভিডারাম (এইচজি) বলা হয়।

নেচার জার্নালে প্রকাশ:

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জিডিএফ-১৫ (Growth/Differentiation Factor 15, or GDF-15) নামে একটি নির্দিষ্ট হরমোন এর সন্ধান পেয়েছে, যা হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারামের জন্য দায়ী। এর কারণেই গর্ভাবস্থায় তীব্র সকালের অসুস্থতায় ভোগেন নারী। গবেষণার ফলাফল ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর নেচার জার্নালে প্রকাশ করা হয়।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১২০ জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বমি বমি ভাব অনুভব করছিল ও বমি করেছিল তাদের মধ্যে জিডিএফ-১৫ হরমোন এর মাত্রা বেশি পাওয়া যায়। তবে যাদের এই হরমোন কম মাত্রায় ছিল তাদের সামান্য বা কোন সকালের অসুস্থতা ছিল না।

মাথা ঘোরানো
যাদের জিডিএফ-১৫ হরমোন কম মাত্রায় পাওয়া গেছে তাদের বমি ভাব বা বমি করার মাত্রা কম 

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপাক গবেষক ও গর্ভবতী নারীদের মনিং সিকনেস নিয়ে করা গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেয়া স্টিফেন ও’রাহিলি বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো, ইমিউনোসেস ও বৃহৎ নমুনার আকার ব্যবহার গবেষণাটি করেছি।’

গবেষণায় দেখা গেছে, যে মাতৃ রক্তে GDF-15 হরমোনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, যেসব অন্তঃসত্তা নারীদের বমি হওয়া বা হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারাম রোগ নির্ণয় করা হয়েছে, তবে এই হরমোন যাদের কম মাত্রায় পাওয়া গেছে তাদের বমি বমি ভাব বা বমি করার মাত্রা কম ছিল।

গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে ভ্রূণ দ্বারা উৎপাদিত হয়:

বমি বমি ভাব বা বমি হওয়ার জন্য দায়ী এই ঘাতক GDF-15 হরমোন গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে ভ্রূণ দ্বারা উৎপাদিত হয়। যেসব নারী এই হরমোনের প্রতি বেশি সংবেদনশীল, তাদের মর্নিং সিকনেস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। গর্ভবতী নারীদের খাওয়া, পান করা ও দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ-কর্ম করাও কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

শুরুর দিকে বমি ভাব বা বমি হলেও পরে ভ্রূণ সঞ্চারের সাথে সাথে তা কমে যায় 

‘এই গবেষণাটি হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারামে আক্রান্ত নারীদের জন্য আরও বিকল্প চিকিৎসা বের করা সহজ হবে। এই সমস্যাটির কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ কি হতে পারে সে সম্পর্কে এখন পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেছে এই গবেষণার মাধমে।’ এমনটাই জানান গবেষক ও’রাহিলি।

হাসপাতালেও ভর্তির প্রয়োজন হয়:

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ওয়েবসাইট অনুসারে,হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারামের কিছু লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দিনে তিন বারের বেশি বমি হওয়া, মারাত্মক ডিহাইড্রেশন হওয়া ও ওজন ১০ পাউন্ড বা তার বেশি কমতে পারে। কিছু নারীদের ক্ষেত্রে হাসপাতালেও ভর্তির প্রয়োজন হয়, এমনকি শিরা দিয়ে তরল প্রবেশ করাতে হয়।

সাধারণত হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারামের প্রভাব প্রথম তিন মাসের সময় বেশি খারাপ হয়। তারপর গর্ভাবস্থায় গর্ভের সন্তান ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলে তা ধীরে ধীরে কমে যায় বলেও গবেষণায় বলা হয়েছে।

তথ্যসূত্র: ফক্স নিউজ, সিবিএস নিউজ, রোম্পার ডটকম, সিইএন