সাব্বিরের বোধোদয়

সাব্বির হাসান, বাবা মায়ের আদরের বাঁদর ছেলে। বাটপারিতে মস্ত বড় ওস্তাদ। কখন কাকে কিভাবে বোকা বানাতে হয় সে কায়দা তার থেকে কেউ ভালো করে জানে না। বাড়িতে রোজ একটা না একটা নালিশ আসতেই থাকে। আর এই নালিশ শোনতে শোনতে বাবা ইকবাল হোসেনের কান জ্বালাপালা হয়ে যায়। ইকবাল হোসেনে রাগে তার স্ত্রীকে বলে এমন এক ছেলের জন্ম দিছো যার জন্য মান সম্মান যা ছিলো পানিতে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। প্রত্যেকদিন পকেট থেকে টাকা চুরি করে ঘরে চুরি করে। না জানি বাইরে কবে থেকে ডাকাতি করা শুরু করবে।

দরজায় কলিংবেল বাজে, ইকবাল সাহেব দরজা খুলে দিতেই দোকানদার হাবিব মিয়া হাতে একটা মোড়া নিয়ে রুমে ঢুকেই বলে পোলারে ডাক দেন নইলে আমার ১০ হাজার টাকা দেন। ইকবাল হোসেন আর তার স্ত্রী কিছুই বুঝতে পারেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করে আমি টাকা দিবো কেনো।

তখন হাবিব মিয়া সব ঘটনা খুলে বলে।

’‘ আপনার পোলা আমারে কইছিলো তার কাছে নাকি গুপ্তধন আছে। তার গুপ্তধনের প্রতি কোনো লোভ নাই, তাই আমারে দিয়া দিবো। প্রথমে আমি বিশ্বাস করি নাই কিন্তু আপনের পোলা মাথাত হাত দিয়া কয়ছিলো তার কাছে এমন একটা জিনিস আছে আমি সারাজীবন বইয়া খাইতারমু। আর আমারে লোভ দেখায় আমার দোকানতে প্রায় দশ হাজার টাকা জিনিস খাইছে। আর আজকে হাতে এই মোড়া ধরাইয়া দিয়া বলে এই সেই গুপ্তধন আমি বইসা বইসা সারা জীবন খাইতারমু।’’

ইকবাল হোসেন ১০ হাজার টাকা দিয়ে দোকানদারকে বিদায় করে।

একটু পর সাব্বির বাসায় এসে চিৎকার করে মাকে ডাকতে থাকে –‘ক্ষুধা লাগছে খেতে দাও‘

ইকবাল হোসেন তাকে হাবিব মিয়ার সাথে বাটপারি করার জন্য যত রকম বকাঝকা করা যায় তাই করতে থাকেন। কিন্তু লাভ নেই বরাবরের মতো এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেওয়া সাব্বিরের কাজ। সাব্বিরের খাওয়া শেষ না হতেই পাশের বাসায় আন্টি এসে হাজির।

শুরু করলেন তার বক্তব্য, সাব্বির কালকে তার লেবু কাছ থেকে লেবু চুরি করেছে। আর সেটার সাক্ষী আমার বাড়ির কাজের মেয়ে। মা কালকে সাব্বিরকে এক হালি লেবু কিনে আনতে বলেছিলো আর সে অন্যের গাছের লেবু চুরি করে এনে নিজের পকেট ভারী করেছিলো।

ইকবাল হোসেন তার স্ত্রীকে বলেন-‘‘ আমার জীবনটা বাঁশ পাতা হয়ে গেছে তেজপাতায় ঘ্রাণ আছে বাঁশ পাতাতে তাও নাই। এতো মারি তারপরেও গন্ডারের চামড়ার শরীরে একটা মাইরো লাগে না। এরে ঘরে শিকল দিয়ে বাইন্ধা রাখো। জীবনটা মজা সময় থাকতে না বুঝলে সময় চলে যাওয়ার পর মাথা চাপড়ালেও কাজ হবে না।’’

সাব্বির বর্তমানে বৃষ্টির সাথে প্রেম করছে । অতীতে সাব্বিরের কয়টা প্রেমিকা ছিল তার হিসাব নেই। বৃষ্টির ব্যবহার করা প্রায়ই সব জিনিস সাব্বিরের দেওয়া। এ নিয়ে বৃষ্টির বান্ধবীরাও বলে-‘‘ কপাল করে একটা বয়ফ্রেন্ড পাইছিস, যে রোজ কিছু না কিছু গিফট করতেই থাকে।’’

কিন্তু কাহিনী ভিন্ন। সাব্বির প্রায় সময় ব্যান্ডের শার্ট, প্যান্ট, জুতো,ঘড়ির ছবি বৃষ্টিকে দেয় বৃষ্টি বুঝতে পারে ডিরেক্ট বলতে না পারলেও সাব্বির চায় সে যেনো গিফট করে। আর এদিকে এসব কিনতে গিয়ে বৃষ্টির টাকা সাব্বিরের থেকে বেশি খরচ হয়। সাব্বির আনমনে হেসে বলে প্রেমিকার পিছনে খরচ তখনই করা উচিত যখন তা উসুল করা যায়।

সাব্বিরের বাবাকে কলেজ থেকে ডাকা হয় ছেলে সেমিস্টার পরীক্ষায় নকল করেছে । ইংরেজি শিক্ষক বলে-‘‘ আগের পরীক্ষায় ইংলিশ খাতায় আপনার ছেলে বাংলাতে লিখেছিল আমাদের মাতৃভাষা বাংলা সেখানে কেনো একদল মানুষ ইংরেজি ভাষা নিয়ে বড়াই করে নিজেকে ইংরেজ পরিচয় দেয়। ইংরেজি চর্চা করা আর বাংলা ভাষাকে অবমাননা করা একই কথা৷’’

ইকবাল হোসেন রাগে কটকট করতে করতে বাড়িতে আসে। বাড়িতে এসে তার স্ত্রীকে বলে- ‘‘ আজ থেকে তোমার পোলার বাসায় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। ওর জন্য আমার সম্মানের ছিটে ফুটাও বাকি নাই। বুঝাও তোমার ছেলেরে। তার মজা করার বয়স চলে গেছে। জীবনটারে হেলায় ফেলায় না কাটাইয়া একটু সিরিয়াস হইতে।’’

সাব্বির তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে-‘‘ খাইলাম না বাসায়। তিন বেলার খাবারের টাকা দিয়ে দিও রেস্টুরেন্টে বসে খাবো৷ ‘’
ইকবাল হোসেন আর কথা বাড়ায় না পাগলরে বুঝাইয়া লাভ নাই ।

বিকাল হতেই মিতুল এসে হাজির, সাব্বিরের মা সাব্বিরকে ডেকে দেয়।
মিতুল বলে-‘‘ আজকে তো মাঠে ফুটবল খেলা ভুলে গেলি নাকি, বিবাহিত আর অবিবাহিতরা আলাদা আলাদা দলে থাকবে। জিতলে ৫০০০ টাকা পাবি হারলে ওদের দিতে হবে।’’

সাব্বির তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হয় বাবার পা ধরে সালাম করে দোয়া চায়।

ইকবাল হোসেন বলেন-‘‘ দেখো সাব্বিরের মা কোনো দিন ভালো কাজে যাওয়ার আগে তোমার ছেলে দোয়া চায় না আকাম কুমাক করার সময় বাপের কথা মনে পড়ে। এইতো আমাদের গুণধর পুত্র।’’

মাঠে টানটান উত্তেজনা, কোনা দল হারবে আর কোন দল জিতবে তা বুঝার উপায় নাই। সাব্বির যে টিমে তারা আরো দুই গোল খেয়ে বসে আছে। খেলার মাঝখানে বিরতির সময় সাব্বির কোথাও একটা উধাও হয়ে যায়। খেলা শুরু হয় কিন্তু গোলকিপার গোল আটকাবে কিভাবে সে শরীর চুলকাতে ব্যস্ত। অনায়েশে সাব্বির এর টিম জিতে জায়। গোলকিপার তখন মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে শরীর চুলকাচ্ছে।

মিতুল সাব্বিরকে জিজ্ঞাসা করে-‘‘ তুই কি কিছু করেছিস নাকি এই ব্যাটা লেটকা মাছের মত শুয়ে এমন করতাছে কেনো।
সাব্বির বলে –‘‘চুতরা পাতার কামাল মামা।’’

বৃষ্টি সাব্বিরকে ফোন দিয়া বলে তার সাথে দেখা করতে। সাব্বির যাওয়ার পর বৃষ্টি জানায় তার বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে।

সাব্বির বলে -তুমি তোমার পরিবারকে বলো তুমি এখন বিয়ে করতে চাও না।

বৃষ্টি বলে- এমনটা হবে না তুমি বাড়িতে গিয়ে প্রস্তাব নিয়ে আসো।

সাব্বির বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে বলে- বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব মানে আমার তো পড়াশোনায় শেষ হয় নাই। চাকরি বাকরি করি না তোমারে খাওয়াবো কি। আর আমার বাবা যদি এটা জানতে পারে তাহলে আমার জুতা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবো। তুমি যদি দুই তিন বছর অপেক্ষা করতে পারো তাহলে বিয়ে কইরো না । আর না পারলে তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে।

বৃষ্টি বলে- প্রেম করার আগে তো খুব বলছিলা আমায় তুমি বিয়ে করবা, এখন তোমার পড়াশোনা শেষ হয় নাই, প্রেম করার আগে এটা মনে ছিলো না। আমি আমার পরিবারে তোমার কথা বলতে পারলে তুই বলতে পারবি না। তুই আমারে ভালোইবাসছ নাই টাইম পাস করছস। আমার বিয়ের দাওয়াত দিয়া গেলাম শুক্রবারে আইয়া খাইয়া যাইস।

শুক্রবারে সত্যি সত্যি সাব্বির তার বন্ধু মিতুলকে নিয়ে বৃষ্টির বিয়ে খেতে যায়। মিতুল না করলেও সাব্বির তার কোন বাড়ন শুনে না। বিয়েতে পেট ভরে খায়। খাওয়ার পরও থেমে থাকে না সে, সোজা বরের সাথে আলাপ করতে বসে পড়ে।

– আমি সাব্বির। বৃষ্টির বন্ধু। বন্ধু বললে ভুল হবে। অনেক ভালো বন্ধু। বৃষ্টি তো আমাকে ছাড়া বাইরে কোথাও বেরই হয় না, সব কিছুতেই আমাকে আগে ডাকে। যাক এখন থেকে আমার সব দায়িত্ব আপনার। আমার বান্ধবীডারে দেইখা রাইখেন।

জামাই ভ্রু কুচকে একবার বৃষ্টি আরেকবার সাব্বির দিকে তাকায়।

এদিকে বৃষ্টির নাজেহাল অবস্থা সাব্বির বিয়ে ভেঙে দিবে নাকি।

সাব্বিরকে এক সাইডে এনে জিজ্ঞাসা করে- এইখানে আসছো কেনো?

সাব্বির হেসে বলে- তুমিই তো বিয়ের দাওয়াত দিলে। আমি একা আসি নাই। সাথে আমার বন্ধুকেও নিয়ে আসছি।

বৃষ্টি সাব্বির কে চলে যাওয়ার জন্য রিকুয়েষ্ট করে।

সাব্বির বলে- বিয়ের অনুষ্ঠান তো শেষ হয় নাই। এখনি চলে যাবো। তবে যেতে পারি মাত্র দুই হাজার টাকা দিলেই হবে।
বৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে টাকা দিয়ে আপদ বিদায় করে।

কলেজের বড় ভাইরা মিলে সাজেক ট্যুরে যাবে সাব্বির আর মিতুলও যাবে, নাম লিখিয়ে আসে। মিতুল টাকা জোগাড় করতে পারলেও সাব্বিরকে তার বাবা কোনো টাকা দেয় না।

সাব্বির মিতুলকে বলে-তুই বাবারে কল দিয়া বলবি আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে। তুই আমারে নিয়া হাসপাতালে আছস। অবস্থা খুব খারাপ, এখনি টাকা লাগবে, বিকাশ নাম্বার দিবি।

মিতুল সাব্বির এর শিখিয়ে দেওয়া কথা মতো কাজ করে। ইকাবাল হোসেন সাব্বির এর দুর্ঘটনা শুনে অস্থির হয়ে পড়ে সাথে সাথে টাকা পাঠিয়ে দেয়৷ এদিকে সাব্বির তার ফোন বন্ধ করে রাখে। পরে কিছু একটা বলে বাবাকে ম্যানেজ করা যাবে। সাব্বির তার সফর ভালোভাবে উপভোগ করতে চায়, এখন প্যারা নিয়ে মুড নষ্ট করাই বোকামি। এদিকে মিতুলের ফোনে সাব্বির এর মা অনবরত ফোন করতেই থাকে সাব্বির কল রিসিভ করতে না করে দেয়।

পাঁচ দিন পর পর ট্যুর শেষে সাব্বির ভয়ে ভয়ে বাসায় আসে। কিন্তু দরজায় তালা দেওয়া। পাশের বাসার আন্টির থেকে জানে তার বাবা হসপিটালে ভর্তি। তাড়াহুড়ো করে সাব্বির হসপিটালে যায়। ইকবাল হোসেন লাইফ সাপোর্টে আছেন তার এক্সিডেন্টের কথা শুনে বুকে ব্যথা শুরু হয়। সাব্বির এর মা সাব্বির এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।

কাঁদতে কাঁদতে বলে-তুই আনন্দ করছিলি। মার ফোন ধরার সময় পাস নি। শুধু তোর জন্য আজ তোর বাবার এই অবস্থা।

সাব্বির পাথরের মতো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। আজকে কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে পারে না। মনে পড়ে যায় তার বাবার বলা কথাগুলো “জীবনটাকে মজা ভেবো না”। আর এই মজার জন্যই তার বাবা আজ জীবন মৃত্যুর অনিশ্চিতায় আছে। এখন তার বোধোদয় হয়েছে কিন্তু হায় সময় চলে যাওয়ার পরে।

কলমে: সুলতানা ফেরদৌস রিমা