কাজী নজরুল-নার্গিস আক্তার ট্র্যাজেডি

সেনাবাহিনীর চাকরি শেষে একুশ বছরের কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় এসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটা ঘরে থাকবার জায়গা পান। আলী আকবর খান নামের একজন পুস্তক প্রকাশক পাশের ঘরে থাকতেন।

নজরুলের সঙ্গে তার সদ্ভাব হয়। লিচুচোর নামে শিশুতোষ একটি কবিতা নজরুল তাকে লিখে দেন।

নজরুলের অল্প কিছু কবিতা ও গল্প তখন কলকাতার পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, ফজলুল হকের নবযুগ পত্রিকায় কিছুদিন চাকরি করেছিলেন- সে চাকরি গেছে।

একদিন (২৩ চৈত্র, ৬ এপ্রিল ১৯২১) যুবক নজরুল, আলী আকবর খানের সঙ্গে তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দৌলতপুরে বেড়াতে যান।

সেখানে আলী আকবর খানদের বনেদী বাড়ি, দোতলা দালান, পুকুর, শান বাঁধানো ঘাট, বাগবাগিচা। পুকুর পাড়ে চৌচালা বৈঠকখানায় নজরুলের থাকার ব্যবস্থা হয়।৩ বাড়িতে পুরুষদের অনেকেই শিক্ষিত ছিলেন; মেয়েরাও অল্প বিস্তর শিক্ষা প্রাপ্ত।

আলী আকবর খানের বড় বোন আসমাতুন নেসার বিয়ে হয়েছিল দৌলতপুর গ্রামেই। স্বামী মৃত। তার এক কন্যার নাম সৈয়দা খাতুন, ডাকনাম দুবরাজ; মামারা সোহাগ করে ডাকতেন যুবরাজ, ভাইয়েরা যুবী বলে।

যুবীর বয়স ষোল। দেখতে সুন্দর। যুবীর মামাদের বাড়ির কাছেই প্রাইমারী স্কুল ছিল। যুবী সেখান থেকে ১৯২০ সালে উচ্চ প্রাথমিক পাশ করেন; আরবী ফারসীর জ্ঞান পেয়েছিলেন, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেও শিখেছিলেন।

কিশোরী নার্গিস আক্তার ও কাজী নজরুল ইসলাম

এই বাড়ির মেয়েদের সম্পর্কে কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী লেখেন: ‘তাদের আদব কায়দা. . স্বভাব এত সুন্দর যে, কোন শিক্ষিতা মেয়ের ভিতর এমন সুন্দর সরল ভাব আমি পাইনি। … সামান্য শিক্ষিত পরিবারের মধ্যে এতটা সুশিক্ষা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি।’

বেড়াতে আসা অতিথি নজরুল বাড়ির বাইরের ঘরে থাকলেও ভিতর-বাড়িতে প্রবেশের বাধা ছিল না। সুদর্শন যুবক। ‘ঝাকড়া চুল। সারা দিন হাসি খুশীতে মেতে থাকতেন। অন্যদের মজিয়ে রাখতেন। গান গাইতেন।

গ্রামের ছেলেমেয়েদেরও গান শেখাতেন। কখনো কখনো জ্যোৎস্না রাতে বাশীতে সুর তুলতেন।’ নজরুল এ বাড়িতে বেড়াতে আসার মাসখানেক পর সৈয়দার বড় ভাই আব্দুল জব্বারের বিয়ে হয় মামাতো বোন আম্বিয়া খানম মানিকের সঙ্গে। সেই বিয়েতে সৈয়দা গানও গেয়েছিলেন।

সেই খানে নজরুলেল সঙ্গে নার্গিসের দেখা, অতঃপর দেখা সাক্ষাৎ, অন্তরঙ্গতা। সৈয়দা খাতুনের নাম পরিবর্তন করে নজরুল তার নাম দেন নার্গিস (নার্গিস আ’সার খানম) – ইরানী ফুল।

আলী আকবর খানের আর এক বিধবা বোন এখতারুন্নেসা ভাইদের বাড়িতেই থাকতেন। নিঃসন্তান এখতারুন্নেসা নজরুলকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। নজরুলও তাকে মা বলে ডাকতেন।

এখতারুন্নেসার আগ্রহে নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ের কথা হয়। বিয়ের দিন ধার্য হয়’ আষাঢ় শুক্রবার ১৩২৮ (১৭ জুন ১৯২১) ‘নিশীথ রাতে’। বিয়েটা ধুমধাম আড়ম্বরপূর্ণ করার চেষ্টা করেন আলী আকবর খান।

নিমন্ত্রণ পত্রে পাত্রকে গৌরবান্বিত করে তোলেন তিনি, ‘আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নি নার্গিস আ’সার খানমের বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের … আভিজাত্য গৌরবে বিপুল গৌরবান্বিত আয়মাদার, জমিনদার, মরহুম মৌলবি কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ-বিশ্রুত পুত্র মুসলিম-কুল- গৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’ কবি, দৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে।’

কুমিল্লার দৌলতপুরে এই ঘরেই থাকতেন কবি নজরুল

এ নিমন্ত্রণ পত্র কলকাতার পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়। নজরুল এ বিয়েতে কতটা উৎসাহিত ছিলেন তার আভাষ পাওয়া যায় বন্ধুদের কাছে লেখা তার চিঠিতে।

দৌলতপুর থেকেই তিনি নার্গিস সম্পর্কে লেখেন,’ চির জনমের হারানো গৃহলক্ষ্মী… প্রিয়া…তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ঠ অর্থাৎ নার্গিস সুশ্রী এবং নজরুলের প্রিয়া ইত্যাদি।

বিয়ের ধুম ধাম গান বাজনা চলে বিয়ের সাত দিন আগে থেকে; বাদ্যকর, বয়াতী এলেন; এলেন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের ভাই বংশীবাদক আফতাবউদ্দীন খানও; এলেন স্থানীয় জমিদার, এলেন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক; কুমিল্লা শহর থেকে এসেছিলেন আলী আকবর খানের বন্ধু বীরেন সেনগুপ্ত, তার মা বিরজাসুন্দরী ও পরিবারের সবাই এবং প্রমীলাও।

বিয়ের দেন মোহর ছিল পঁচিশ হাজার টাকা। বিত্তশালী বনেদী পরিবার; তবু সেই আমলে পঁচিশ হাজার টাকা দেনমোহর অবিশ্বাস্য। নার্গিসের বড় ভাই আব্দুল জব্বার বলেন যে, বিয়ের দেনমোহর ছিল বিশ হাজার টাকা, তার নিজের বিয়ের অনুরূপ।

নার্গিস বলেন, এ রকম দেনমোহর তাদের পরিবারের রেওয়াজ ছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানাদি শেষে অনেক-রাতে নজরুল-নার্গিসের অবসর হয় ক্ষণিকের বাসর সাক্ষাতের। সেই সাক্ষাতেই বিপর্যয়।

কিছু একটা ঘটল যার দরুন নজরুল বিক্ষুব্ধ উভ্রান্ত। তিনি আর থাকবেন না ওখানে। অতিথি, গণ্যমান্য অভ্যাগতদের মাঝে অপ্রস্তুত খা বাড়ির অনেকে তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করলেন।

কিন্তু নজরুল বেপরোয়া। প্রত্যুষে বীরেন সেনগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে দৌলতপুর ত্যাগ করে চলে এলেন। বিয়ে বাড়ি বিষাদে ছেয়ে গেল।

কুমিল্লাজুড়ে চিরভাস্বর বিদ্রোহী নজরুল

কি এমন ঘটলো যে বিয়ের বাসর ছেড়েই তিনি চলে এলেন? এ প্রশ্নের উত্তর আছে নজরুলের চিঠিতে। বিয়ের কয়েক দিন পর নজরুল আলী আকবর খানকে লেখেন, “সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে, লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপন জনের কাছ হতে পাওয়া এমন অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে।”আঘাত এসেছে আপন জন অর্থাৎ নার্গিস এর কাছ থেকে, উপলক্ষ ‘পথের ভিখারী’ অর্থাৎ দারিদ্র্য।

নজরুলের সহায় সম্বল অর্থ-সঙ্গতির বিষয়ে আলী আকবর খান এবং বাড়ির অভিভাবকগণ অবহিত ছিলেন। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকে তাকে ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে উড়ে এসে জুড়ে বসা ছেলে বলে ভাবতেন।

বিবাহে আমন্ত্রিত আত্মীয়গণের কৌতুহল স্বাভাবিক যে – ছেলে কি করে, কি আছে? বউ নিয়ে রাখবে কোথায়? বিয়েতে বর পক্ষের কেউ আসেনি কেন? বর্ধমানে কিই বা আছে? নিমন্ত্রণ পত্রে আলী আকবর খানের লেখা গৌরবগাথা এসব গুঞ্জন প্রতিহত করতে পারেনি।

নজরুলের বিষয় বৈরাগ্য বা দারিদ্র্য নিয়ে ‘বাড়ির দাসদাসীরাও ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করতে ছাড়েনি।’এর ক’ দিন আগে আলী আকবর খানের ভাই ওয়ারেস আলীর মেয়ে হেনার সঙ্গে নজরুলের বিয়েতে বাড়ির লোকেরা রাজি হয়নি। সেই প্রত্যাখ্যাত ভবঘুরের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে!

আগে হয়তো এ সব বিষয় আমলে নেননি কিন্তু এখন নার্গিস দিশেহারা। বাসর সাক্ষাতেই সংঘাত। নজরুলের চিঠি তারই ইঙ্গিতবহ।

বিস্ময়ে বিমূঢ় আহত নজরুল নার্গিসকে বলেছিলেন ঐ পরিবেশ ছেড়ে ঐ রাতেই যেন নার্গিস নজরুলের সঙ্গে দৌলতপুর ছেড়ে আসে।

নার্গিস ঐ মুহূর্তে অমন সিদ্ধান্ত নেবার সাহস পান নি। নজরুল আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, মাসখানেক পরে আসছে শ্রাবণে বাড়ি থেকে আত্মীয়স্বজন নিয়ে এসে নার্গিসকে নিয়ে যাবেন।

 

নজরুলের দ্বিতীয় স্ত্রী আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা দেবী

আলী আকবর খানকে লেখা চিঠিতেও নজরুল লিখেছিলেন, ‘দোয়া করবেন যেন আমার … এ অভিমান চোখের জলে ভেসে যায়। বাকি উৎসবের জন্য যত শীঘ্রই পারি বন্দোবস্ত করবো।’সে অভিমান আর ভাঙ্গেনি। শ্রাবণ গেছে, ভাদ্র আশি^ন গেছে- তিনি আর আসেননি।

নিরুপায় আলী আকবর খান মাসতিনেক পরে কলকাতার তালতলা লেনে নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নমনীয় করেন এবং নজরুল তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তিনি চিঠি দিয়ে জানাবেন যে কবে তিনি দৌলতপুর যাবেন।

তাল তলা লেনের ঐ বাসাতেই তখন মুজফফর আহমদও থাকতেন। তিনি দেখেছেন যে নজরুলকে আলী আকবর খান এক তাড়া দশ টাকার নোট দিতে চেষ্টা করেছেন, নজরুল তা নেন নি। নজরুলের আর্থিক সঙ্কটের বিষয়টি নার্গিসের কোনো কোনো গুরুজন সহানুভূতির সঙ্গে দেখতেন।

বিয়ের আগে তাদের মধ্যে এ নিয়ে কথাও হয়েছে। এখতারুননেসা প্রস্তাব করেছিলেন যে তারা তিন বোন তাদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে জুবী আর নজরুলের জন্য ঢাকা বা কলকাতায় বাড়ি করে দেবেন; ততদিন জুবী না হয় দৌলতপুরেই থাকবে।

কিন্তু কারও দয়া দাক্ষিণ্য নজরুলের কাছে ছিল অবমাননাকর। নজরুল আর দৌলতপুর যাননি। নার্গিস পথ চেয়ে রইলেন। দীর্ঘ সে পথ-চাওয়া।

নার্গিস সুশ্রী ছিলেন, তরুণী ছিলেন। বিয়ের ক্ষণে স্বামী ছেড়ে গেছে। স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে অন্যত্র বিয়ে করাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নার্গিস তেমন কিছুই হতে দিলেন না। পথভোলাা পথিকের পথ চেয়েই রইলেন।

নজরুল আশা দিয়েছিলেন যে আত্মীয়স্বজন নিয়ে এসে নার্গিসকে নিয়ে যাবেন। নজরুলের গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ায় দালান কোঠা ছিল না কিন্তু সাধারণ গৃহস্থের উপযুক্ত বসতবাড়ি ছিল; নার্গিসকে সেখানে সসম্মানে রাখতে পারতেন নজরুল।

নার্গিসের মামারা বিত্তশালী ছিলেন, নার্গিস অতটা নন। কলকাতায় বা কোথাও কষ্টে-শিষ্টে দু’জনে থাকতেও পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। সম্পর্কটা শুরুতেই বিষিয়ে গেছে। নজরুলের হৃদয়ে অপমানের আগুন জ্বলেছে।

বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন ‘মনের অশান্তির আগুন দাবানলের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।’

প্রমীলা দেবী কাজী নজরুল ও তাদের দুই পুত্র সন্তান কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ

লিখেছিলেন ‘আমার পথের বাসা হাতের সুখে বানিয়ে এমন করে পায়ের সুখে ভেঙে পথে দাঁড়ালাম? . . এই বন্ধন ছিন্ন করে . . দুঃখ পেয়েছি আমিই সব চেয়ে বেশি। আমার নিজের বুকই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে… হিয়ায় হিয়ায় আমার এক বীভৎস খুন-খারাবি . . খানখান খুন!. . . কেমন এক বিদ্রোহ অভিমানে আমার দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে . . .নাই- নাই, এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা নিয়ন্তা কেউ নাই।’

‘এই আঘাত আমার কাছে ভীষণ দুর্বিসহ। . .বাইরে ভিতরে আগুন . . আমার দুশমনি মানুষের ওপর নয়, মানুষের স্রষ্টার ওপর।’আঘাত পেলেন মানুষের কাছ থেকে কিন্তু অভিমান করলেন মানুষের স্রষ্টার উপরে।

পুঞ্জীভূত নানা অভিমানই বিদ্রোহ হয়ে ফুটে ওঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। ‘বিদ্রোহী’ লিখে নজরুল বিখ্যাত হলেন। নার্গিসকে যখন বিয়ে করেছিলেন, পরিচিতি ছিল না, খ্যাতি ছিল না। যখন খ্যাতি হলো, অবোধ বালিকার যখন চৈতন্যের উদয় হলো, বাধনহারা কবি তখন নাগালের অনেক বাইরে। বিষন্ন নার্গিস শুধু প্রতীক্ষাতেই রইলেন।

স্বামী কুমিল্লায় কান্দিরপাড়ে আবার বিয়ে করলেন (১৯২৪)। নার্গিস বিশ্বাসই করতে পারেননি, ভাবতে পারেননি যে তাকে পথে ফেলে নজরুল প্রমীলাকে নিয়ে ঘর বাধবেন। ভরণ পোষণ দাবি ক’রে, দেনমোহর দাবি ক’রে নার্গিস লড়তে পারতেন, কিন্তু লড়েননি।

দেনমোহর ছিল পঁচিশ হাজার টাকা। এত টাকা এক সঙ্গে একত্র করার মতো প্রকৃতি নজরুলের ছিল না। ক্ষণিকের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ক’রতে নার্গিস অনেক বছর দৌলতপুরেই ছিলেন। চিঠি লিখেও কবির কাছ থেকে সাড়া পাননি।

মামা আলী আকবর খান কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় পুস্তক ব্যবসায়ে মন দেন। ঢাকার বাংলা বাজারে বাড়ি বানান। নার্গিসকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। নার্গিস আবার পড়াশোনা শুরু করেন। চৌদ্দ বছর পর উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন।

১৯৩৭ সালে ৩২ বছর বয়সে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আই এ পাস করলেন। ইডেন গার্লস কলেজ তখন সদর ঘাটের দিকে ছিল।

নার্গিস আক্তার ও কাজী নজরুল ইসলাম

নার্গিস সাহিত্য চর্চাও করেন। তার কবিতায় নজরুলকে না পাবার ব্যথা, বিরহ, একাকিনী থাকার কষ্ট মূর্ত হয়ে উঠতো। একাধিক উপন্যাস নার্গিস লিখেছিলেন। উপন্যাসগুলোতে স্বামী কর্তৃক অবহেলিতা স্ত্রীর আক্ষেপ ভরপুর।

তার এমনি একটি উপন্যাস ‘তাহমিনা’। পারস্য-বীর রুস্তম কর্তৃক ফেলে যাওয়া স্ত্রী তাহমিনার বিলাপ নার্গিস সবিস্তারে লিখেছেন, লিখেছেন পুরুষ জাতির নির্দয়তা, পাষাণচিত্ততা। ‘তাহমিনা’ পড়ে নজরুল তার উত্তরে লেখেন কবিতা ‘হিংসাতুর’।

নজরুল নিজেও যে ব্যথিত, এ কবিতায় সে কথা জানিয়েছিলেন (১৯২৮)। নার্গিসের লেখা উপন্যাস ‘ধুমকেতু’ এবং ‘পথের হাওয়া’ও নজরুলকে উপলক্ষ ক’রে– ধূমকেতু মানুষের হৃদয় আকাশে উদিত হ’য়ে সব ছারখার করে দেয়, ভ্রাম্যমাণ পথিক নিস্তরঙ্গ জীবন ওলট পালট করে দিয়ে আপনার পথে ফিরে যায় – এমনই বেদনা চিত্রিত নার্গিসের লেখা এসব উপন্যাসে।

নার্গিসের বিড়ম্বনার জন্য আলী আকবর খান ব্যথিত ছিলেন। তার প্রকাশনা সংস্থার স্বত্ব এবং ঢাকার বাড়ি তিনি নার্গিসকে দিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ির নাম চিরকালই ছিল নার্গিস ম্যানশন। নজরুলকে নার্গিস চিঠি লিখেছেন।

সম্পূর্ণ কাঙ্গাল হয়ে, সকরুণ মিনতি করে লিখেছেন যে, তিনি (নার্গিস) তার পথ চেয়ে আছেন, তাকে না পেলে বেঁচে থাকার অর্থ নেই, … আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন; প্রমীলাকে বিয়ে ক’রেছেন তাতে কিছু আসে যায় না, একবারটি . . যেন দেখা করেন।

নজরুল নার্গিসকে চিঠি দিয়েছিলেন একটি ১.৭.৩৭ তারিখে,’ আমি কোনো জিঘাংসা পোষণ করি না . .আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা।

নার্গিস আক্তার ও কাজী নজরুল ইসলাম

কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি . . তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না, আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হ’তে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়ে আছে আমার বক্ষে।

. . তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুনবতী কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে। তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে আপত্তি নেই। . . আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ ক’রলে না।

পাষাণ দেবীর মতোই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদী-পীঠ। জীবন ভরে সেইখানেই চলেছে আমার পূজা-আরতি। . .যদি কোনো ভুল করে থাকো এই জীবনে, এই জীবনেই তার সংশোধন করে যেতে হবে। … আজ চ’লেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষ রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর।’

বিবাহ বিপর্যয়ের সকল দায়ভার এ চিঠিতে নজরুল নার্গিসের উপর চাপিয়েছেন, নার্গিসকেই দোষারোপ করেছেন। শ্লেষাত্মক মন্তব্যও করেছেন, ‘তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুনবতী কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে।’

এই উমেদার কারা? নার্গিসের শুভ্যানুধায়ীরা? যারা নজরুলের দারিদ্র্য নিয়ে নার্গিসের মন বিষিয়ে দিয়েছিলেন, বিপর্যয় ঘটিয়েছিলেন, দুটি জীবন বেদনায় বিদীর্ণ করেছিলেন? নার্গিসের ক্ষণিকের ভুল নজরুল ক্ষমা করতে পারেননি, কিন্তু চিরকাল তার স্মৃতি, তার জন্য মর্মবেদনা হৃদয়ে বয়ে বেরিয়েছেন।

এ বেদনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে অসাধারণ কবিতা, গান, সাহিত্য। ‘বিদ্রোহী, ‘ধূমকেতু’ ‘চক্রবাক’ ‘পূবের হাওয়া’ আরো কত গ্রন্থ কবিতা; ‘প্রথম মনের মুকুল, ঝরে গেল হায় মিলনের ক্ষণে’ ’গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে/ আজো সে পথ চাহে সাঝে’, ‘তুমি বুঝিবে না কি অভিমান / মিলনের মালা করিল ম্লান’ – আরও কত শত গান!

নজরুলের ১.৭.৩৭ তারিখের ঐ চিঠিতে (এবং নার্গিসের চিঠিতেও) এক তিক্ত ঘটনার উল্লেখ আছে। ১৯২৮ সালে ঢাকা শহরে রাতের আঁধারে নজরুলকে আক্রমণ করা হয়; নজরুলের ধারণা যে সে আক্রমণ চালায় নার্গিসের পক্ষের লোকেরা এবং নার্গিসের ধারণা যে সেই ঘটনার কারণে নজরুল ঢাকা যেতে ভয় পেতেন।

ভয় দূরের কথা; আক্রমণকারীদের লাঠি কেড়ে নিয়ে তিনি তাদের মেরে তাড়িয়েছিলেন। উভয়ে উভয়ের জন্য সহমর্মিতার ঘাটতি ছিল না। কিন্তু তৃতীয় শক্তি অতি-শুভ্যার্থির কর্মকাণ্ড সে সম্পর্ক বিষিয়ে গেছে- দূরত্ব বর্ধিত হয়েছে।

নার্গিস আশা ছাড়েননি। স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ষোল বছর পর কলকাতা আসেন। সঙ্গে ছিলেন মামাতো ভাইয়েরা। ১৯৩৭ সালের ৪ নভেম্বর। শিয়ালদহ হোটেলে নজরুল আসেন। দেখা হয়।

নার্গিস তার মিনতি আকুতি তুলে ধরেন। নজরুল বলেন, নার্গিসকে প্রমীলা এবং তার মা সহ্য করবে না; নার্গিস ঢাকাতেই থাকুক; নজরুল ঢাকা এসে একটা ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু নজরুল এ নিয়ে আর ঢাকা আসেননি।

অতঃপর নার্গিস নতুন বিয়েতে সম্মত হন। ১৭ বছর প্রতীক্ষার পর ১৯৩৮ সালের ২০ এপ্রিল নার্গিসের তিন জন ভাই কলকাতা থেকে তালাকনামায় নজরুলের স্বাক্ষর নিয়ে আসেন। দেন মোহরের টাকা, সতেরো বছরের ভরণপোষণ, বিত্তশালিনীর অহমিকা সবই পরিত্যাগ করেন নার্গিস।

তারও প্রায় আট মাস পর উনিশ শ’ আটত্রিশের বারোই ডিসেম্বর নার্গিস দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন। এ বিয়ের প্রাক্কালে নজরুল নার্গিসকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন, ‘তোমাকে পেয়েও হারালাম। তাই মরণে পাবো- সেই বিশ্বাস ও সান্তনা নিয়ে বেঁচে থাকব।

. . আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি করেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না। ‘’সঙ্গে একটা গান ছিল, ‘তোমার প্রিয় যদি পাশে রয়/ মোরও প্রিয় সে করিও না ভয়/ কহিব তারে আমার প্রিয়ারে/আমারো অধিক ভালবাসিও।’

নার্গিসের দ্বিতীয় বিবাহ হয় নজরুলের স্নেহধন্য কবি আজীজুল হাকিমের সঙ্গে। আলী আকবর খানের পুস্তক ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আজীজুল হাকিম। আজিজুল হাকিমের পূজনীয় পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম নার্গিসের দ্বিতীয় বিবাহের তিন বছর পর ঢাকায় আসেন।

আজীজুল হাকিম তখন তাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন। ১৯৪০ সালে। বড় বিচিত্র এ ভক্তি এ ভালবাসা। নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের শেষ সাক্ষাৎ হয়। নজরুল এ সাক্ষাতে আবেগ আপ্লুত হন।

১৯৪২ সালে কবি নজরুল চৈতন্য হারিয়ে ফেলেন। তবু সেই চৈতন্যহারা কবি অবচেতন মনে একদিন কাগজে লেখেন ‘দৌলত নার্গিস ত’বেঁচেই আছে। ওর ছেলের বুলবুল ত’ বেঁচেই আছে।’

আশ্চর্য বটে – শরীর অসুস্থ, চৈতন্য বিলুপ্ত তবু প্রাণের গহীনে হারানো প্রিয়ার স্মৃতি তড়পায়। প্রায় ২৪ বছর সংসার অতিবাহিত হওয়ার পর ১৯৬২ সালে নার্গিসের স্বামী আজীজুল হাকিম মৃত্যুবরণ করেন।

একাত্তরের প্রারম্ভে নার্গিস বিলেতে ছেলের কাছে চলে যান। নজরুলের মৃত্যুর পর একবার দেশে এসে নজরুল সমাধিতে গিয়েছিলেন নার্গিস। অনেকটা নিভৃতে।

১৯৮৫ সালে ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারে একমাত্র সন্তান ডাঃ ফিরোজের বাসভবনে ৮১ বছর বয়সে নার্গিসের মৃত্যু হয়।

লেখাটি দৈনিক জনকন্ঠ থেকে নেয়া। লিখেছেন: এ. এফ. এম. মাহবুবুর রহমান।