ফিচার

হিমশীতল উত্তর মহাসাগর এর জীবনযাপন

সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীটা একদিকে যেমন রহস্যময় অন্যদিকে অপরুপ সৌন্দর্য্যে ঘেরা। পৃথিবীর তেমন এক বিস্ময়কর ও বৈচিত্রপূর্ণ নাম উত্তর মহাসাগর।

পৃথিবীতে যে পাঁচটি মহাসাগর রয়েছে, এর মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে ছোট এটি। এর অবস্থান পৃথিবীর একেবারে উত্তর প্রান্তে। আর এ কারণে এটি সুমেরু মহাসাগর নামেও পরিচিতি পেয়েছে। ইংরেজিতে এটিকে আর্কটিক ওশেন বলা হয়।

এর আয়তন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৬ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর সর্বোচ্চ গভীরতা ৫ হাজার ৬২৫ মিটার। আর গড় গভীরতা ১ হাজার ৩৮ মিটার।

উত্তর মহাসাগর এর বরফে বিশাল গর্ত

ইউরেশিয়ান বেসিন এই মহাসাগরের গভীরতম স্থান। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে উচু বুর্জ খলিফার ৭টি ভবন অনায়াশেই ডুবে যাবে।

মহাসাগরটির কিছুটা অংশ প্রায় সারা বছরই বরফে আবৃত থাকে। আর শীতের সময় প্রায় পুরোটাই ঢেকে যায় বরফে। পৃথিবীর বাকি চারটি মহাসাগরের চেয়ে এ মহাসাগরের পানির লবণাক্ততা কম।

বাষ্পীভবনের নিম্নহার, ছোট-বড় বিভিন্ন নদী থেকে আসা মিঠা পানির প্রবাহ, অন্যান্য মহাসাগরগুলোর সঙ্গে সীমাবদ্ধ যোগাযোগ ও বহির্গমন স্রোতের কারণেই লবণাক্ততার পরিমাণ।

গ্রেটার নর্থ সীতে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল

উত্তর মহাসাগরের একদিকে পরাশক্তি রাশিয়া অন্য পাশে আমেরিকাসহ এর ৬টি দেশ। রাশিয়া নরওয়ে আইসল্যান্ড গ্রীনল্যান্ড কানাডা ফিনল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এই মহাসাগর অবস্থিত। এর অধিকাংশ দখল করে আছে রাশিয়া। এরপর আছে কানাডার দখলে।

আটলান্টিক মহাসাগরের বেরিং প্রণালি, আলাস্কা, কানাডা, উত্তর ইউরোপ এবং রাশিয়ার পুরো উপকূল দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে মিশেছে।

এ মহাসাগরে গ্রীস্ম ও শীত এই দুই মৌসুমে বিভক্ত। গ্রীষ্ম মৌসুমে তাপমাত্র শুন্য ডিগ্রি থাকে। শীতের সময় এর গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রি কখনো কখনো ঠাণ্ডার পরিমাণ মাইনাস ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছে যায়।

বরফাবৃত উত্তর মহাসাগর এ পেঙ্গুইনদের বিতরণ

এই মহাসাগরে বরফের গড় স্তর ৩-৪ মিটার। তবে সর্বোচ্চ স্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে ২০ মিটার পুরত্বের, যা প্রায় সাড়ে ছয়তলা উচুঁ ভবনের সমান। যে বরফগুলো ভাঙার ক্ষমতা কোন জাহাজের নেই।

এতো ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়ও এর তীরবর্তী দেশগুলোতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বসতি রয়েছে। এর মধ্যে আর্কটিক রাশিয়ান টেরিটরিতে বসবাস করে ২০ লাখ মানুষ। আর বাকি অর্ধেক বসবাস করে অন্য দেশের আর্কটিক উপকূলজুড়ে।

মানুষের পর বরফের উপরিভাগে বসবাস করে পোলার বিয়ার্ড বা মেরু ভাল্লুক। প্রায় সাদা ও ধূসরসহ প্রায় ৩০ হাজার পোলার বিয়ার্ডের বসবাস রয়েছে উত্তর মহাসাগরে।

উত্তর মহাসাগর এর ঠাণ্ডা পানিতে মাছের বিচরণ

পোলার বেয়ার্ড কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত পানির নিচে থাকতে পারে। এটি এই মহাসাগরের অন্যতম আকর্ষণ। হিমশীতল এই মহাসাগরে সর্বাধিক পরিচিত প্রাণিদের মধ্যে ৬ প্রজাতির সীল, ভেলুগা, পেঙ্গুইন ও সমুদ্র সিংহ।

আর পানির নিচে ক্রিল মাছ ও সালমন মাছসহ ২০ প্রজাতির মাছের বসবাস রয়েছে। এর মধ্যে অনেক মাছ এ মহাসাগরের বাইরের পানিতে পাওয়া যায় না। ক্রিল বাস্তুসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অন্যদিকে গ্রে হোয়েল, ব্লু হোয়েল, মিংক হোয়েল, বহেড, ভেলুগা এবং নেরো হোয়েলের মতো ব্যতিক্রমী তিমিসহ সব মিলিয়ে প্রায় ১৭ প্রজাতির তিমির বসতি রয়েছে এই মহাসাগরে। এর বিভিন্ন উপকূলে প্রায় ২৮০ প্রজাতি পাখি দেখা যায়।

উত্তর মহাসাগর থেকে খনিজসম্পদ উত্তোলন

এই মহাসাগর আয়তনে ছোট হলেও পুরো বিশ্বের ২৫ শতাংশ খনিজ সম্পদ আছে এর অভ্যন্তরে। তেল ও গ্যাসের বিপুল ভান্ডার রয়েছে এই মহাসাগরে।

এছাড়া টিন, ম্যাঙ্গানিজ, স্বর্ণ, নিকেল, ডায়ামন্ড, সীসা, জিপসাম, ইউরেনিয়াম, টাইটেনিয়াম, জিঙ্ক, সিলভার ও প্ল্যাটিনামের মতো প্রায় ৭০০ ধরনের খনিজ সম্পদ রয়েছে।

এ মহাসাগরে রয়েছে ১১টি ইকোনোমিক এক্সক্লসিভ জোন। এর মধ্যে তিনটি রাশিয়ার। বাকিগুলো কানাডা ও নরওয়ের। এই খনিজ সম্পদের অর্ধেকের বেশির মালিক রাশিয়া।

উত্তর মহাসাগরের গভীরে নীল তিমিদের জল খেলা

রাশিয়া ইতোমধ্যে তেল গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে। এ মহাসাগরে বেশ কয়েকটি ভাসমান গবেষণা স্টেশন স্থাপনা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।

বাণিজ্যিক সুবিধার্থে বেশ কিছু বন্দর ও পোতাশ্রয় গড়ে তোলেছে। কানাডার চার্লিল, ইউনিবিট, মার্কিন যুক্তরাষ্টের ফিতোয়ে বে, বে রো রাশিয়ার প্যারিক, টিকশিন ও ডিকশন সমুদ্রবন্দর অন্যতম।

অন্যান্য মহাসাগরের মতো এরও কিছু সাগর ও উপসাগর রয়েছে। এর মধ্যে বাফিন উপসাগর , বেরেন্টাস সাগর, বিফোর্ট সাগর, চুকসি সাগর, গ্রীনল্যান্ড সাগার , হার্ডসন উপসাগর, কারা সাগর, ল্যাপটভ সাগর ও শ্বেত সাগর।

উত্তর মহাসাগরের একটি অংশ সারা বছরই বরফে ঢাকা থাকে

এ ছাড়া কানাডার ম্যাকেঞ্জি নদী, আলাস্কার কোলবিল নদীসহ বেশ কিছু নদীর পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই মহাসাগরে পতিত হয়। তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা ঋতু অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়।

গত ৫০ বছরে এর বরফের পরিমাণ ২৮ ভাগ বেড়েছে। বরফ গলা এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ বছরের মধ্যেই এ মহাসাগর বদলে দিতে পারে বিশ্ব বাণিজ্যের গতিপথ।

বরফের স্তর ভেদ করে যদি এশিয়া ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় তবে পুরনো রোড সুয়েজ খাল ও আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে যাতায়াত করা জাহাজগুলোর সামুদ্রিক পথ ৪ হাজার কিলোমিটার পথ কমে আসবে। তাতে অর্থ ও সময় দুটোই বেঁচে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: