উমা কাজী নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ। বড় ছেলে সব্যসাচী কাজীর স্ত্রী উমা। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকা অবস্থায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেন “উমা কাজী”।
উমা কাজী ঢাকার বনানীতে থাকতেন। তবে দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানান সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। উমা কাজী তাঁর দুই মেয়ে খিলখিল কাজী ও মিষ্টি কাজীকে রেখে যান।
উমা কাজীর স্বামী সব্যসাচীর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। একসময় কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গেই তাঁর পরিবার ঢাকায় চলে এসছিলেন। তারপর থেকে কবির পরিবারের প্রায় তিন প্রজন্ম বাংলাদেশেই থাকে।
উমা কাজীর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতার পাশাপাশি হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়েও তিনি বেশ কিছু দিন হাসপাতালে ছিলেন। ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এর মধ্য দিয়ে নজরুলকে আগলে রাখা এক নক্ষত্র ওপারে চলে যায়। তবে মৃত্যুর পরেও তাকে সবাই স্মরণ করছেন কারণ শ্বশুর কাজী নজরুলকে আগলে রাখার জন্য।
তার শ্বাশুড়ি প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর থেকেই বাক শক্তি হারানো বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন উমা।
নজরুল ইসলাম নিজের মা বাদেও আর এক জন নারীর মধ্যে নিজের মাকে খুঁজে পেয়েছিলেন, যে নারী মায়ের ভালোবাসায় সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন নির্বাক কবিকে। আজ সেই মায়ের গল্প বলবো।
ভালবাসা আর স্নেহ দিয়ে যে সমস্ত রকম ভেদাভেদ দূর করা যায়, তার উদাহরণ যেন সেই মানুষটি– উমা কাজী। তিনি ছিলেন উমা মুখোপাধ্যায়।
হিন্দু ও বাহ্মণ পরিবারের কন্যা হয়েও মুসলিম পরিবারের পুত্রবধূ হয়েছিলেন সেই কত বছর আগে। কিন্তু এমন অনন্য ঘটনা কখনওই প্রচারের আলোয় আসেনি তাঁরই অনিচ্ছায়।
উমার বাবা ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং মা বাদলা মুখোপাধ্যায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উমা।
লেখাপড়া শেষ করে কলকাতার ‘লেডি ডাফরিন হাসপাতাল’ থেকে ট্রেনিং নিয়ে নার্স হয়েছিলেন উমা মুখোপাধ্যায়। ছোট থেকেই সেবিকা হতে চাইতেন তিনি।
লেডি ডাফরিনের নার্স হোস্টেলেই থাকতেন। সেখানকারই এক হেড নার্স ঊষাদি উমাকে এক নতুন পথের দিশা দেখান। উমাকে তিনি নিয়ে যান অসুস্থ কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাড়ি।
কবির সেবা করার জন্য প্রয়োজন ছিল এক নার্সের। নির্বাক কবি তখন কলকাতার মাণিকতলায় ছিলেন। নানা অসুস্থতায় জর্জরিত হলেও, দুই বাংলাতেই তখন কবিকে নিয়ে উন্মাদনা কমতি ছিল না।
এমনই সময়ে কবির মাথার কাছে গিয়ে বসলেন তরুণী উমা। নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবী বলেছিলেন “তুমি কি পারবে কবির সেবা করতে? ঐ দেখো, উনি খবরের কাগজ ছিঁড়ছেন। উনি এখন শিশুর মতো।”
এ প্রশ্নের উত্তরে উমা বলেছিলেন “আমরা তো কলকাতার হাসপাতালে শিশু বিভাগে ডিউটি করেছি। কবি যদি শিশুর মতো হন, নিশ্চয়ই পারব।”
সেবা ও স্নেহের পথে ক্রমে উমাই হয়ে উঠলেন কবি নজরুলের প্রিয় মানুষ। তাঁকে গোসল করানো, খাওয়ানো, দেখভাল করা, গল্প শোনানো– উমার হাতের স্পর্শ যেন কবির কাছে মায়ের আঁচলের মতো হয়ে ওঠে।
কিন্তু এরই মধ্যে ঘটল আর এক কাণ্ড। উমার সেবা দেখে, মিষ্টি ব্যবহার দেখে কবির বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী পড়ে গেলেন উমার প্রেমে। উমাও সব্যসাচীকে মন দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ভিন্ন ধর্মে অসম ভালবাসা সমাজ কী মেনে নেবে?
উমার বাড়ি থেকে এদিকে উমার বিয়ের পাত্র দেখা শুরু হয়েছে। সরকারি কর্মচারী এক সুপাত্রকে খুঁজেও ফেলেছেন উমার দুলা ভাই। উমা অনেক সাহস সঞ্চয় করে জানিয়ে দিলেন, “সব্যসাচীকে আমি ভালবাসি। ওকেই বিয়ে করব।”
বাড়িতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সকলে এ কথা শুনে। পরিবারের পক্ষে থেকে উমাকে বলা হয়, “মুসলিম বিয়ে করে কোনও দিন যদি দুঃখ পাও, তখন আমরা কিন্তু আর তোমাকে ফেরত নেব না।”
উমা বলেছিলেন, “দুঃখ করতে যদি নেমেই থাকি, দুঃখে পড়লেও কাউকে জানাব না।”
বিয়ে হল বামুনের মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের। সে সময়ে একরকম অসম্ভব একটা ব্যাপার। ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রেখে উমা মুসলিম পরিবারকে আপন করে নিলেন। হয়ে উঠলেন উমা কাজী।
কবি ও প্রমীলা দেবীও এমন এক মেয়েকে ঘরের বৌমা হিসেবে পেয়ে খুশি হলেন। উমা মুসলিম পদবী গ্রহণ করলেও, তাঁর নামে থেকে গেল মা দুর্গার মতো উমা।
জানা যায়, শাশুড়ি প্রমীলা দেবী বৌমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। দুই ছেলেকে খাবার দিয়ে বৌমাকেও নিজে রান্না করে, বেড়ে খাওয়াতেন তিনি। এদিকে কবিও বৌমা অন্ত প্রাণ।
বৌমা চন্দন সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে না দিলে স্নান করবেন না নজরুল, দাড়ি বৌমাই কেটে দেবে, খাইয়ে দেবে বৌমা। আদরের বৌমার কাছে শিশুর মতো বায়না করতেন কবি।
এমনকি গোসলের পরে জামা-কাপড় পরিয়ে নীল বোতলের সুগন্ধীও বৌমাকেই লাগিয়ে দিতে হবে। যা প্রতিনিয়তই পালন করতে থাকলেন সব্যসাচী স্ত্রী উমা।
উমা একদিকে নিজের নতুন সংসার সামলাচ্ছেন অন্যদিকে কবিকেও সামলাচ্ছেন। ধীরে ধীরে এল সব্যসাচী-উমার তিন সন্তান, মিষ্টি কাজী, খিলখিল কাজী ও বাবুল কাজী।
তিন নাতি-নাতনি দাদার কাছেই থাকত বেশি সময়। কবিও তো শিশুর মতোই। সন্তানদের সঙ্গেই কবিকেও আসন পেতে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দিতে হতো উমাকেই।
পরে কাজী নজরুল ইসলামকে সুস্থ করতে দুটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়, যে বোর্ডের সদস্যদের কবির সমস্যাগুলোর সব কিছু বুঝিয়ে দিতে যেতেন উমাই।
কীভাবে কবির স্মৃতিশক্তি ফেরানো যাবে, কথা বলানো যাবে–এসব ভাল করে শুনে সেবার ধরনও বুঝে নিতেন উমা। পাশাপাশি স্বামীর খেয়াল রাখা থেকে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা– সবটাই দেখতেন উমা কাজী।
একবার উমা তাঁর ছোট ছেলে বাবুল কাজীকে শুইয়ে রেখে রান্না ঘরে গেছেন, এসে দেখেন ছেলে নেই। খোঁজাখুঁজি শেষে দেখেন কবি বসে কাগজ ছিঁড়ছেন তার ঘরে, আর সেই স্তূপাকৃতি ছেঁড়া কাগজের মধ্যে নাতি বাবুলকে শুইয়ে রেখেছেন তিনি।
তাকে দেখে পরমানন্দে হাততালী দিচ্ছেন বৃদ্ধ কবি। উমা কাজী তো হতবাক, বাবার কাণ্ড দেখে! শোনা যায়, উমা ছেলে-মেয়েকে শাসন করলে তাঁকে হাততালি দিয়ে বকে দিতেন নজরুল। ওঁর নাতি-নাতনিকে কেন বকবেন উমা!
প্রমীলা দেবী এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শাশুড়ির সব দেখভালের দায়িত্বও নিলেন উমাই। কবির আগেই চলে গেলেন কবিপত্নী প্রমীলা দেবী।
আরো পড়ুনঃ কাজী নজরুল-নার্গিস আক্তার ট্র্যাজেডি
দীর্ঘ ৩৮ বছরের সংসার জীবনের পর, ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন মাত্র ৫২ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তাঁর দেহ কলকাতা থেকে চুরুলিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। হাজী পাহালোয়ানের দরগার পাশে সমাহিত করা হয় তাঁকে।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে বাংলাদেশে আনা হয় সপরিবারে। ধানমন্ডির ২৮ নম্বর রোডে (বর্তমান নজরুল ইনস্টিটিউট সংলগ্ন) কবি ভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁরা বসবাস শুরু করেন।
কাজী সব্যসাচী কর্মসূত্রে কলকাতায় থেকে গেলেও উমা কাজী কবিকে দেখার জন্য ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ধানমণ্ডির বাড়িতে নজরুল নাতি-নাতনি নিয়ে খেলা করতেন, বাগানে ঘুরে বেড়াতেন।
শেষ দিকে শৌচাগারেও যেতে পারতেন না নজরুল। বিছানাতেই সব। মুখ বুজে পরিষ্কার করতেন উমা। কোনও অভিযোগ নেই। তিনি যে সেবিকা, তিনি যে মা।
তাই তো এত কিছুর মধ্যেও এতটুকু ফাঁক পড়েনি ছেলে-মেয়েকে বড় করায় বা শাশুড়ির অবর্তমানে সমগ্র সংসার সামলানোয় বা কাজী সব্যসাচীর যোগ্য সহধর্মিণী হয়ে ওঠায়।
কবির জন্মদিন পালন হতো বেশ বড় করে। অতিথিরা আসতেন, সবাই মালা পরাতেন কবিকে। কবি সেইসব মালা পরে খিলখিল করে হাসতেন। হারমোনিয়াম দেখিয়ে সবাইকে বলতেন গান করতে।
নাতি-নাতনিরাও নজরুলসঙ্গীত গাইতেন। নির্বাক কবিই কখনও হেসে উঠতেন আবার কখনও নির্বাক হয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে যেতেন একটার পর একটা নিজের সৃষ্টি শুনে। সব যন্ত্রণা যেন গানেগানে ঝরে পড়ত কবির চোখের জলে।
২৯ আগস্ট ১৯৭৬ কবি প্রয়াত হন। শেষ মুহূর্ত অবধি সমস্ত সেবা একা হাতে করে গেছেন উমা। শেষ সজ্জায় কবিকে সাজিয়েও দিয়েছেন নিরুচ্চার সাধনায়। বছর তিনেক পরে ১৯৭৯ সালের ২ মার্চ কলকাতায় মারা যান আবৃত্তিকার কাজী সব্যসাচী। অকালেই চলে যান অসুখে।
ফলে জীবনযুদ্ধের আরও কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে উমার ওপর। তখন ভগ্ন হয়ে আসছে কাজী পরিবারের যশ-খ্যাতি। একা হাতে বিখ্যাত কবি পরিবারকে কঠিন লড়াইয়ের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করেন উমা।
তিনি না থাকলে কাজী পরিবার আজ খ্যাতির জায়গাটা হয়তো ধরেই রাখতে পারতেন না। বিখ্যাত পরিবারে বিখ্যাত সদস্যদের পেছনে কাণ্ডারী কমলার মতো শক্তির উৎস হয়ে উঠেছিলেন এই উমা।
তবে উমা কি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন মিডিয়ার সামনে? কেন? কাজী পরিবারের অন্য সদস্যরা যেখানে প্রচার আলোতেই বেশিরভাগ থাকেন সেখানে উমা আজীবন নিজেকে অন্তরালে রাখলেন কেন?
কোথাও কি চারুকলায় সে অর্থে উমা পারদর্শী ছিলেন না বলেই এই অন্তরাল। এই বিভাজন! উমা নার্স থেকে কাজী পরিবারের বউ হন। কাজী পরিবারের অন্য মেয়ে-বৌদের মতো উমা গানে বা বাচিকশিল্পে পারদর্শী ছিলেন না।
একজন সেবিকা, আরেকজন গায়িকার মধ্যে সেবিকাকে আমরা কোনকালেই বা সেলেব্রেটি তকমা দিয়েছি? অথচ উমা আগলে রেখেছিলেন একটি তারকা পরিবারকে।
উমা যখন দাদী-নানী হলেন, তখন তিনিও কবির মতোই তাঁর নাতি-নাতনিদের গল্প বলতেন। কাজী নজরুল, প্রমীলা দেবী, সব্যসাচী সবার কথা তিনি বলতেন নাতি-নাতনিদের।
তারাও কাজী নজরুলকে ছুঁতে পারত উমার গল্পে। উমা জানতেন, উত্তরাধিকারী নবীন প্রজন্মকে কবির কাজে আগ্রহী করলে কবির কাজ বেঁচে থাকবে, আরও এগোবে তাঁর সৃষ্টি।
উমা যেন সারাজীবন শ্রীকৃষ্ণ সাধিকার মতোই কবির সেবিকা ও সাধিকা হয়ে রইলেন। আর স্থান করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।
এই ভাবেই ৮০টি বসন্ত পেরিয়ে প্রয়াত হলেন উমা। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতার পাশাপাশি হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
শেষ দিকে স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছিলেন, কবির মতোই। ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকায় প্রয়াত হন ভালবাসা, মনুষ্যত্ব ও সেবার ধর্ম সারাজীবন ধরে পালন করা মানুষ উমা কাজী। বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।