প্রবীণ-নবীন শিল্পীদের ‘ছাপাইচিত্রের পরম্পরা’ প্রদর্শনী

পঞ্চাশের দশক থেকে সমকালীন শিল্পীদের নির্বাচিত শিল্পকর্ম নিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বেঙ্গল শিল্পালয়ে ১১ মে শুরু হয়েছে মাসব্যপি ‘ছাপাইচিত্রের পরম্পরা’ প্রদর্শনী। প্রদর্শনী চলবে আগামী ১১ জুন পর্যন্ত।

ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরম্পরা ও নিরীক্ষা প্রবণতা তুলে ধরতে আয়োজন করা হয়েছে এ প্রদর্শনীর। ৭৫ জন শিল্পীর ৮০টির বেশি ছাপচিত্রকর্ম নিয়ে ছাপচিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন রোববার ছাড়া প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে শুক্রবারসহ অন্যান্য দিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।

প্রদর্শনী চলবে আগামী ১১ জুন পর্যন্ত

দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার পুরোধা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী প্রমুখ ছাপচিত্রের মর্যাদা ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে দেশে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি-উদ্যোগে বহু ছাপচিত্র স্টুডিও গড়ে ওঠে, নবীন শিল্পীরা চর্চা অব্যাহত রেখে চলেছেন।

বরেণ্য শিল্পী অধ্যাপক রোকেয়া সুলতানার সাথে শিল্পী মুকাদ্দাস সাদী আহমেদ মোকাদেসুর

এই প্রজন্মের শিল্পী মুকাদ্দাস সাদী আহমেদ মোকাদেসুর বলেন, ‘‘ছাপচিত্র নিয়ে কাজ করছি প্রায় আঠার বছর যাবত। অনার্স আর মাস্টার্স করেছি ছাপচিত্র বিভাগ, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।’’

‘‘এর মধ্যে দুইটা একক চিত্র প্রদর্শনী করেছি। ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিয়মিত দলীয় প্রদর্শনী ও চিত্র কর্মশালাতে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছি। জাতীয় চিত্র প্রদর্শনী ও এশিয়ান আর্ট বিয়েনালে অংশ গ্রহন করেছি। দেশের বাইরেও প্রদর্শনী করেছি।’’

শিল্পী রফিকুন নবীর উড কাঠের একটি শিল্প কর্ম

তিনি আরও বলেন, ‘‘ছাপাইচিত্রের পরম্পরা শীর্ষক প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের যারা গুরু, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী, কালিদাস কর্মকার, রফিকুন নবী, মুর্তজা বশীর, রোকেয়া সুলতানার মতো শিল্পীদের সাথে আমার কাজ ও আছে। এটা আমার শিল্প জীবনের একটা বড় সার্থকতা এবং অনেক গর্বের।’’

সমসাময়িক সময়ে যারা কাজ করছেন তাদের ও শিল্পকর্ম আছে এখানে। আমি মূলত আমার কাজের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে বেড়াই। সৃষ্টি রহস্যকে খুঁজে বেড়াই। যেমন এই প্রদর্শনীতে যেই কাজটি প্রদর্শিত হচ্ছে এটার শিরোনাম “আমার আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে” যোগ করেন তিনি।

‘ছাপাইচিত্রের পরম্পরা’ প্রদর্শনীতে শিল্পী শহিদ কবির

তিনি বলেন, মূলত আমি বার বার দুই হাত তুলে মোনাজাত করছি, যে বিশ্বে শান্তি ফিরে আসুক। আমার এই সিরিজ কাজটি অনেক বছর যাবত চলমান। সূফীবাদের প্রাধান্য আমার কাজে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমি  মাধ্যম হিসেবে ছবিকে বেছে নিয়েছি।

কারণ ছবির ভাষা সার্বজনীন। এখানে ছাপচিত্রের ড্রাইপয়েন্ট ও এচিং মাধ্যমে কাজটি করেছি। ছবিতে নতুন কচি পাতার একটি গাছ দেখিয়েছি। যেন মানব জীবন প্রতিনিয়তই নতুনের মতো থাকে,শুদ্ধ থাকে। আমি আল্লাহ্‌র দরবারে শান্তি চাইছি সকল প্রাণীকূলের জন্য বলেন এই গুণী শিল্পী।

বেঙ্গল শিল্পালয়ে ‘ছাপাইচিত্রের পরম্পরা’ প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে বিশিষ্টজনরা  

এই প্রসঙ্গে বরেণ্য শিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘ছাপচিত্রের কাজ একটা নেশার মতো। কত সস্তা উপকরণ দিয়েও যে ছাপচিত্র করা যায়, সেটা বাংলাদেশে দেখা যায়। যেমন উডকাটের কাজ।’’

তিনি বলেন, ‘‘প্রিন্ট মেকিং হচ্ছে শিল্পের এমন একটি মাধ্যম, যা মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। তবে দ্রুতগতিতে কাজে অনেক সময় শিল্পে দুর্বলতা থেকে যায়।’’ একটি শিল্প তৈরির সময় কতটা ধৈর্য নিয়ে শেষ করতে হতো, সে অভিজ্ঞতার কথা জানান তিনি।

ধানমন্ডিতে বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলছে ‘ছাপাইচিত্রের পরম্পরা’ প্রদর্শনী

শিল্পী শহিদ কবির বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ছাপচিত্রের উপকরণ খুব নগন্য। অনেক উপকরণ শিল্পীদের হাতে তৈরি করে নিতে হয়। তবু দেশের ছাপচিত্র বিশ্বের কোনো দেশের চেয়ে কম নয়।’’

সেই বক্তব্যেরই সমর্থন করতে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী বীরেন সোম বলেন, শিল্পী মনিরুল ইসলাম আয়োজিত একটি কর্মশালার কথা। একটি প্লেটে চারটি রং ব্যবহারের স্মৃতিচারণা করেন তিনি।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, ‘‘পঞ্চাশের দশক থেকে ছাপচিত্রের যে একটি বিবর্তন এসেছে, তা রয়েছে এ প্রদর্শনীতে। এখানে ছোট ছোট কিছু ভিডিওর মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে করণকৌশল।’’

‘বাড়ির পথে’, শিল্পী: সফিউদ্দীন আহমেদ, উডকাট, ১৯৪৪

দেশে ছাপাই ছবির চর্চা শুরু হয়েছিল একাডেমিক অনুশীলনের মাধ্যমে। শিক্ষক ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ ও হাবিবুর রহমান। সাদা–কালো কাঠ খোদাই চিত্রের মাধ্যমে এর সূচনা হলেও পরে এচিং, লিথোগ্রাফি ইত্যাদির চর্চাও শুরু হয়।

সফিউদ্দীনের প্রথম দিকের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর প্রমুখের একাডেমিক বাস্তবধর্মী রীতিতে করা কাঠখোদাই চিত্রের কিছু নমুনা এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ছাপাই ছবি একাডেমিক চর্চার পরিধি পার হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, মূলত সফিউদ্দীন ও মোহাম্মদ কিবরিয়ার নেতৃত্বে। পাশ্চাত্য আধুনিকতার অনুবর্তী হয়ে বিমূর্ত বা আধা বিমূর্ত ধারায় তাঁরা চর্চা শুরু করলেন।

‘ আমার আল্লাহর সান্নিধ্যে’, শিল্পী: মুকাদ্দাস সাদী আহমেদ মোকাদেসুর 

স্বাধীনতার পর দেশে ছাপাই ছবি জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম ও কালিদাস কর্মকার পথিকৃৎ। রফিকুন নবী গেলেন কাঠখোদাই চিত্রে; বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি ও জীবনের বর্ণাঢ্য জগতে।

কালিদাস কর্মকার গেলেন এচিংয়ের রেখাময়তায়, আমাদের পৌরাণিক আচারের উদ্ভাসে। মনিরুল ইসলাম এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে স্বচ্ছ জলরঙের মতো বিমূর্ত আঙ্গিকে এক নিজস্ব বর্ণময় ধারা সৃষ্টি করলেন। এই প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ছাপচিত্রের ভুবনের চকিত পরিচয় আছে।

দুটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো। একসময় বিশ্বজুড়ে ছাপচিত্রে সমাজবাস্তবতার যে বিপুল আবির্ভাব দেখা গিয়েছিল, দেশে তার অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আরেকটি বিষয় হলো, নতুন প্রজন্মের অধিকাংশ শিল্পীর মধ্যে এই মাধ্যমে নিছক একাডেমিক বাস্তবধর্মী রীতির প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মতো নিরীক্ষার প্রতি কম।