একদিন রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় ভৃত্য বনমালীকে বললেন ‘আচ্ছা বনমালী, তুই কি জানিস যে আমি খুব বড়লোক?
বনমালী জবাব দিল – হ্যাঁ বাবামশায়,জানি৷ আবার প্রশ্ন -‘কিসে বড়লোক বলতো,দ্বারকানাথের লাতি বলে’?
বনমালী হাত কচলাতে কচলাতে উত্তর দিল বলব? বলব?
আপনি নেকার জোরে বড়লোক? অক্ষরজ্ঞানহীন বনমালীর মুখ থেকে বেরিয়েছিল এই ধ্রুবসত্য৷
বলা বাহুল্য ভৃত্য হলে হবে কি কবির জীবিতকালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের শেষ জন্মদিনে তাঁর সামনে ‘বশীকরণ’ নাটকে বনমালী অভিনয় পর্যন্ত করেছেন।
সেই নাটকেও তাঁকে চাকরের ভূমিকায় দেখে সবাই হেসে খুন।
রবীন্দ্রনাথ শুধু কি বনমালীর মনিব ছিলেন! মোটেও নয়,তিনি ছিলেন তাঁর বাবামশায়৷ অপত্যস্নেহে রবীন্দ্রনাথ দেখতেন বনমালীকে।
স্নেহ,ভালবাসা,রসিকতার সঙ্গে মাঝে মাঝে কৃত্রিম ক্রোধ প্রকাশ করলেও বনমালীর সুখ-সুবিধার বিষয়ে তিনি ছিলেন অসম্ভব সচেতন।
সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই রবি কবির জীবনে সফল ভৃত্যদের তালিকায় সবার উপরে বনমালীর নাম থাকবে।
বনমালীকে তিনি মাঝে-মাঝে ‘নীলামণি’ বলতেন, আর কবির কখন কি দরকার সব তাঁর নখদর্পণে ছিল। রবীন্দ্রনাথ আবার বনমালীর ভাষা আর চালচলন নিয়ে মজা করতে বেশ পছন্দ করতেন। তিনি ও মৈত্রেয়ী দেবী বিষয়টি বেশ উপভোগ করতেন৷
একদিন কবি মৈত্রেয়ী দেবী কে বললেন আমি ঠিক করেছি বনমালীর মত বলব ‘নাম্বা’। এতদিন ওকে বলছি ‘নাম্বা’ নয় ‘লম্বা’ কিন্তু ও যখন কিছুতেই শুনবে না তাহলে তাঁকে ওর ভাষাটা নিতে হয়
কবি ছবি আঁকবেন বলে তৈরি হচ্ছেন, মৈত্রেয়ী দেবী কবি কে জিজ্ঞেস করলেন ‘আচ্ছা কি কি রং গুলব’? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বললেন আহা আগে কাগজটাকে ‘নাম্বা’করে কাটো তবে তো।
সেদিন বনমালী ঘুমিয়ে পড়েছিল। দুপুর বেলা বেশ ঝড় উঠেছে, কবি তখন লিখছেন, ঝড়ের দাপটে ঘরের জানালাগুলো জোরে জোরে খুলছে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে এসবের মধ্যে বনমালী ফুরসৎ বুঝে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে
এত হৈ হট্টগোলে তাঁর আর ঘুম ভাঙলো না। রবীন্দ্রনাথের মন চাইল না তাঁকে জাগিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ঘুম ভাঙানোর।তিনি লেখা ছেড়ে একটি একটি করে সব জানালা বন্ধ করলেন।
ভেবেছিলেন বনমালীর ঘুম ভাঙবে। আবার স্বস্থানে ফিরে কবি স্মিতহাস্যে বললেন ‘ঘুমিয়েছে বেচারা। হঠাৎ জাগালে ধড়মড় করে উঠে শেষটা একটা অনর্থ করে বসবে। এসব টুকিটাকি কাজ গৃহস্থ লোককে করে নিতে হবে বৈকি’।
চাকর হলে কি হবে বনমালী কিন্তু একবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সামনে শান্তিনিকেতনে তাঁর শেষ জন্মদিনে “বশীকরণ’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন।
অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শিনী নির্মলকুমারী লিখেছেন—সন্ধ্যাবেলা উদয়নের পূর্বদিকের আঙিনায় সামিয়ানার নীচে দর্শকদের বসবার জায়গা এবং চাতালের উপরে অভিনয়ের আয়োজন
কবি নিজে চাতালের একধারে আরাম চৌকিতে বসলেন।প্রথমে কয়েকটা গান ও সঙ্গে সঙ্গে নাচ হল-ছেলেমেয়েরা মিলে করলে;তারপর ‘বশীকরণ’ নাটকটিক অভিনয়।
‘অভিনয় খুব ভালোই হল। সকলে নিজের অংশ খুব ভালো করে করেছিল। এর মধ্যে সত্যি সত্যিই উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের পুরাতন ভৃত্য বনমালী।
তাকে চাকরের ভূমিকাতেই নামানো হয়েছিল। বনমালীর আবির্ভাবে সবাই হেসে খুন। ও কিন্তু তাতে একটুও কাবু না হয়ে ঠিক স্বাভাবিকভাবেই ‘আজ্ঞে হ্যাঁ মাঠাকরুণ’ এবং অতিথিকে জলখাবার এনে দেওয়া, হাত ধোয়ানো ইত্যাদি সব বেশ সপ্রতিভ ভাবে করে গেল’।
লেখা সংগৃহীত