অভ্যুত্থান

সিনেমার ভাষায় বিপ্লব-অভ্যুত্থান

অভ্যুত্থান মানে শুধু রক্ত আর গোলাগুলি নয়। অভ্যুত্থান একটটি চিন্তার জন্ম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, নতুন কোনো সমাজ গড়ার স্বপ্ন। এই সংগ্রাম, এই উত্তাল সময়, এই মানবিক দ্বন্দ্ব, সবই অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন সিনেমায়।

ইতিহাস ও কল্পনার মিশেলে তৈরি এমন পাঁচটি সেরা অভ্যুত্থানভিত্তিক সিনেমার গল্প তুলে ধরা হলো জার্নালস মনিটরের এই আয়োজনে, যেগুলো শুধু বিনোদন নয়, বরং ভাবনার দুয়ারও খুলে দেয়-

লা মিজারেবলস (২০১২)
বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগোর ‘ম্যাগনাম ওপাস’ ‘লা মিজারেবলস’-কে ২০১২ সালে পর্দায় ভিন্নভাবে তুলে ধরেন টম হুপার। ফ্রান্সের ১৮ শতকের শেষ ভাগ ও ১৯ শতকের শুরুর সময়কে কেন্দ্র করে নির্মিত। ফরাসি বিপ্লবের পরে গঠিত সমাজেও যেভাবে বৈষম্য, নিপীড়ন ও অন্যায় টিকে ছিল, তারই দলিল এই চলচ্চিত্র।

বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লবের পরে গঠিত সমাজেও যেভাবে বৈষম্য, নিপীড়ন ও অন্যায় টিকে ছিল, তারই দলিল এই চলচ্চিত্র, ছবি : প্রাইম ভিডিও

টম হুপার এমন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসকে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে মিউজিক্যালে রূপ দিয়েছেন অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে। সিনেমাটির প্রতিটি গানে লুকিয়ে আছে আত্মত্যাগ, ভালোবাসা আর সামাজিক পরিবর্তনের আহ্বান। এটি একাধারে ইতিহাস, আবেগ আর অনুপ্রেরণার মেলবন্ধন।

দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিস (২০০৪)
চে গুয়েভেরাকে কি কেবল একজন বিপ্লবী বললে ভুল হবে? এই সিনেমা বলে, তার জন্ম হয়েছিল একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে। মোটরসাইকেলে করে চে ও তার বন্ধু আলবার্তো যখন দক্ষিণ আমেরিকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান, তাদের চোখে ধরা পড়ে বাস্তব জীবনের কঠোর রূপরেখা- অবিচার, দারিদ্র্য, শোষণ।

বিপ্লব
তরুণ চে ও তার বন্ধু আলবার্তোর এই সফর তাদের মনে বিপ্লবের বীজ বপন করে, ছবি : সিটি কিনোস

এই যাত্রা একটি মানুষের ভেতরের বিপ্লবের বীজ বপন করে, যা পরবর্তীতে বিশ্বের বুকে আন্দোলনের এক প্রতীক হয়ে ওঠে। চে’র নিজস্ব ডায়েরি অবলম্বনে তৈরি এই রাজনৈতিক সিনেমা পরিচালনা করেন ব্রাজিলিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা ওয়াল্টার সালেস।

জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)
বাংলাদেশের সিনেমা ও সাহিত্য জগতের কালপুরুষ জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি এই সিনেমা। চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয় ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে, ১৯৫২- ৭০-এর অভ্যুত্থানমূলক সময় হিসেবে যখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক চেতনায় প্রবল জাগরণ শুরু হয়েছিল।

বিপ্লব
জহির রায়হান এই সিনেমাতে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্পে প্রতীকীভাবে স্বৈরতন্ত্র ও প্রতিরোধের রূপ তুলে ধরেন, ছবি : সংগৃহীত

জহির রায়হান এই সিনেমার মাধ্যমে শাসকদের স্বৈরাচার, মানুষের নিপীড়ন, ও জাতীয় চেতনাকে রূপকৌশলে তুলে ধরেন। সিনেমাতে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্পে প্রতীকীভাবে উঠে আসে স্বৈরতন্ত্র ও প্রতিরোধের রূপ। পরিবারের একনায়কতন্ত্র ভেঙে দেয় নতুন প্রজন্মের সাহসী কণ্ঠ। শেষ পর্যন্ত বিচার ও ন্যায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্রের জয়। সিনেমা বিশেষজ্ঞদের কাছে ‘জীবন থেকে নেয়া’ বাংলাদেশে নির্মিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা।

দ্যা ব্যাটল অব আলজিয়ার্স (১৯৬৬)
সিনেমার পটভূমি গড়ে উঠেছে ১৯৫৪-১৯৬২ সাল পর্যন্ত আলজেরিয়ার ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র কাল্পনিক হলেও পুরো গল্প বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে। সিনেমাটি ফোকাস করে জনসাধারণের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠা বিদ্রোহ, যেখানে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরাও হয়ে ওঠে প্রতিরোধের প্রতীক।

বিপ্লব
এই সিনেমা অনেক দেশেই নিষিদ্ধ করা হয়, ছবি : পপকাল্ট রিভিউস

একদিকে ফরাসি সেনাবাহিনীর নির্মম দমননীতি, অন্যদিকে মুক্তিকামী মানুষের সাহসিকতা। এটি একটি নব্য-রিয়ালিস্টিক চলচ্চিত্র, যেখানে কোনো পেশাদার অভিনেতা ছিল না। সিনেমাটি এতটাই বাস্তব ছিল যে বিভিন্ন দেশে এটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। আজও এটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।

রাং দে বাসান্তি (২০০৬)
উপমহাদেশের সিনেমাপ্রেমীদের অন্যতম প্রিয় সিনেমা ‘রাং দে বাসান্তি’। চলচ্চিত্র নির্মাতা রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহেরা ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক ভারতকে বিপ্লবের সুতায় বেঁধে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। সিনেমায় দেখা যায় ব্রিটিশ এক তরুণী ভারতে আসে ভারতের বিপ্লবীদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে। এতে অভিনয় করে নাচ-গান, আড্ডা আর উদাসীনতায় ডুবে থাকা পাঁচ তরুণ। দেশ তাদের কাছে ছিল কেবল একটা ভৌগোলিক সীমা।

বিপ্লব
‘রাং দে বাসান্তি’ নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়, ছবি : দ্যা রিভল্ভার ক্লাব

কিন্তু ইতিহাসের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়েই তারা স্পর্শ করে ফেলে এক অন্যরকম সত্য, বিপ্লবের রক্তাক্ত গল্প। এদিকে একটি দুর্ঘটনা ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের অবিচার তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারা বুঝতে পারে- বিপ্লব শুধু অতীতে নয়, বর্তমানেও প্রয়োজন। সিনেমার একটি উক্তি বিপ্লবের চেতনায় জাগ্রত যেকোনো তরুণের রক্ত গরম করে দিতে পারে। আর তা হলো- ‘নেতা আসমান থেকে টপকে পড়ে না, আমাদের মধ্য থেকেই তারা আসে। আমরাই তাদের নেতা বানিয়েছি। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে আমরাও দুর্নীতিগ্রস্ত!’

অনারেবল মেনশন- ভি ফর ভেনডেট্টা (২০০৫)
অ্যালান মুর গ্রাফিক নভেল অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমার কথা না বললেই নয়। ২০ বছর আগে নির্মিত এতে ফুটে উঠেছে বিপ্লবের এক কাল্পনিক গল্প যা সমসাময়িক বাস্তবতায় এখনো দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। এর পটভূমি ব্রিটেন যেখানে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায়। সাধারণ মানুষের উপর নজরদারি, বাকস্বাধীনতার দমন এবং মিডিয়ার অপব্যবহার চালু আছে। এর গল্পে দেখা যায় ‘ভি’ নামের এক মুখোশধারী বিপ্লবীকে, যিনি সরকারের মিথ্যা ও দমননীতি উন্মোচন করতে চায়।

বিপ্লব
‘ভি ফর ভেনডেট্টা’ সিনেমার বাস্তবতা বর্তমান দুনিয়ার জন্য এখনো প্রাসঙ্গিক, ছবি : আইএমডিবি

তার সঙ্গে যুক্ত হয় এক তরুণী ইভি, যার জীবনেও আসে পরিবর্তন। ভি ধ্বংসের মাধ্যমে তৈরি করতে চায় একটি নতুন সমাজব্যবস্থা। এই সিনেমায় তার পরিহিত ‘গাই ফক্স মাস্ক’ আজ এক বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী প্রতীক। এই সিনেমার একটি উক্তি আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই উক্তিটি হলো- ‘ জনগণের তাদের সরকারকে ভয় পাওয়া উচিৎ নয়। বরং সরকারের উচিৎ তাদের জনগণকে ভয় পাওয়া।’