সাগরের বুক চিরে হঠাৎই উঠে আসে এক বিশাল ঢেউ। চারপাশের ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিগুণ উঁচু, ভয়াবহ ও বিস্ময়কর। এই ধরনের ঢেউকে বলা হয় রগ ওয়েভ (Rogue Wave)।
আগে এগুলো ছিল নাবিকদের গল্পের মতো অবিশ্বাস্য ও অলৌকিক। কিন্তু এখন বিজ্ঞান বলছে, এই দানবীয় ঢেউ একেবারেই বাস্তব ও প্রকৃতিরই অংশ।
সম্প্রতি ন্যাচার সাইন্টিফিক রিপোর্টে প্রকাশিত ১৮ বছরের নির্দিষ্ট এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা অবশেষে জানালো এই ভয়ংকর ঢেউগুলো কোনো রহস্য নয়। বরং নিয়মিত প্রকৃতির নিয়ম মেনেই তৈরি হয়।
রগ ওয়েভ হলো এমন একধরনের দানবীয় ঢেউ যা মুহূর্তেই সৃষ্টি হয়। এটি সাধারণ ঢেউয়ের চেয়ে ২ থেকে ৩ গুণ উঁচু হতে পারে। গড়ে ২০ মিটার (৬৫ ফুট) বা তার বেশি উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে এই ঢেউ।
স্থায়িত্ব মাত্র ৩০ থেকে ৬০ সেকেন্ড তারপর মিলিয়ে যায়। এই ঢেউ এতটাই শক্তিশালী যে জাহাজ ও তেল প্ল্যাটফর্ম ধ্বংস করে ফেলতেও সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে ও ইউরোপের বিজ্ঞানীদের এক আন্তর্জাতিক দল ২০০৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১৮ বছর ধরে উত্তর সাগরে (North Sea) অবস্থিত ইকোফিস্ক (Ekofisk) তেল প্ল্যাটফর্মে লেজার ডেটা সংগ্রহ করে।
তারা প্রায় ২৭ হাজার ৫০০টি সি স্টেট (সমুদ্রের অবস্থা) বিশ্লেষণ করেছেন। প্রতি ৩০ মিনিটে একবার করে মাপা হয় সমুদ্রের ঢেউ কেমন ছিল। এই বিশ্লেষণে উঠে আসে রগ ওয়েভ আসলে কোনো অপ্রত্যাশিত, বিরল এবং হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নয়। এটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফলাফল।
আরো পড়ুন : এবার চাঁদে পাওয়া যাবে ফোর জি নেটওয়ার্ক
এত বিশাল ঢেউ তৈরি হয় যেভাবে
আগে মনে করা হত মডুলেশনাল ইনস্টেবিলিটি (modulational instability) নামের একটি জটিল গাণিতিক থিওরির মাধ্যমে এসব ঢেউ হয়। এটি ল্যাবরেটরির নির্দিষ্ট চ্যানেল বা সীমাবদ্ধ পরিবেশে ভালো কাজ করে।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, উন্মুক্ত সমুদ্রে এই থিওরি ঠিক কাজ করে না। প্রকৃত সমুদ্রে ঢেউ আসে বিভিন্ন দিক থেকে তাই বাস্তবতা ভিন্ন।
গবেষণায় দেখা যায়, রগ ওয়েভ তৈরি হয় যখন অনেক ছোট ছোট ঢেউ একসাথে জড়ো হয়ে যায়। আর সম্মিলিত ঢেউয়ের চূড়া একে অপরের সাথে মিলে একটি বিশাল ঢেউ তৈরি করে।
একে বলা হয় কন্সট্রাকটিভ ইন্টারফেরেন্স (Constructive Interference-ছোট ঢেউ একসাথে যুক্ত হয়ে এক বিশাল ঢেউ বানায়)। কোয়াজি-ডিটারমিনিজম (Quasi-Determinism) এই ঢেউ তৈরি হয় এমন এক প্যাটার্নে যা মোটামুটি আগেই অনুমানযোগ্য। তবে কিছুটা এলোমেলোও হয়।
২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর, উত্তাল উত্তরের সাগরে এক শক্তিশালী ঝড়ের সময় ইকোফিস্ক (Ekofisk) প্ল্যাটফর্মের ক্যামেরায় ধরা পড়ে একটি ৫৫ ফুট (প্রায় ১৭ মিটার) উঁচু রগ ওয়েভ।

বিজ্ঞানীরা এআই (AI) মডেল ও বোকোট্টি (Boccotti) এর তত্ত্ব ব্যবহার করে দেখেছেন, এই ঢেউ তৈরি হয়েছিল ছোট ছোট ঢেউয়ের বারবার মিলনে। ঠিক কন্সট্রাকটিভ ইন্টারফেরেন্স ও কোয়াজি-ডিটারমিনিজম অনুযায়ী।
রগ ওয়েভ শুধু সমুদ্রেই নয় অন্যান্য ওয়েভ সিস্টেমেও দেখা যায়। নদীর জল প্রবাহ, বায়ুর স্রোত, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শব্দ বা আলো তরঙ্গেও।
এই গবেষণা ভবিষ্যতে সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজ ও প্ল্যাটফর্মগুলোর সতর্কতা ব্যবস্থা উন্নত করতে পারে। গবেষকরা বলেন, যদি আমরা রগ ওয়েভ তৈরির প্যাটার্ন চিহ্নিত করতে পারি তাহলে হয়তো আগাম সতর্কবার্তাও দেওয়া সম্ভব হবে।
আরো পড়ুন : সাগরের নিচে ১০,০০০ বছর আগের রহস্যময় পিরামিড
রগ ওয়েভ কোনো রহস্য নয় বরং সাগরের খারাপ দিনের প্রকাশ মাত্র। যখন অনেক ঢেউ একসাথে মিলে যায় তখনই সাগর দেখায় তার আসল রূপ। আপনার চারপাশের সমুদ্র যতই শান্ত মনে হোক, একটি মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে সবকিছু। তাই বিজ্ঞান যখন রহস্য উন্মোচন করে তখন তা শুধু জানার জন্যই নয়। বাঁচার উপায় হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র : সাইন্স এ্যালার্ট