মরুর সুবাসিত সৌন্দর্যের প্রতীক সৌদির “গোলাপ নগরী”

সৌদি আরবের মরুভূমির বুকে এক অনন্য সৌন্দর্যের নাম তায়েফন ‘গোলাপ নগরী’। বৈচিত্র্যময় ভূ-সংস্থান, পর্বত, সুশোভিত ঝরনাধারা, পাহাড়ি মেঘ পর্যটকদের এখানে আসার হাতছানি দেয় প্রতিনিয়ত।

তাছাড়া ধারাবাহিকভাবে সারা বছরই সহনীয় তাপমাত্রা দিয়ে সৌদি আরবের পার্বত্য অঞ্চলকে উর্বর রেখে যাচ্ছে তায়েফ। রবি শস্য ও নানা ফল-ফলাদির জন্য তায়েফ বিখ্যাত।

তায়েফে উৎপন্ন আঙ্গুর, কমলা, আনার মিষ্টি ও পুষ্টিতে ভরপুর। বিশেষ করে তায়েফের আঙ্গুর বিখ্যাত। এ ছাড়া তায়েফে উৎপাদিত সবজি সৌদি আরবের চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ পূরণ করে।

এর বাইরে এই শহরটি গোলাপের জন্য বিখ্যাত। প্রতিটি পাঁপড়ি বয়ে আনে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য।

একজন লোক ক্ষেত থেকে তোলা বুনো গোলাপগুলো পরীক্ষা করছে, ছবি: এএফপি

মরুর বুকে গোলাপ রাজ্য:

তায়েফের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় ৮০০টি ফুলের খামার রয়েছে। যেখানে বছরে প্রায় ৩০ কোটি গোলাপ উৎপন্ন হয়। এই গোলাপগুলো শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং তারা তায়েফের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের অংশ। জীবন্ত কাব্য। 

প্রতিটি গোলাপের পাঁপড়ি সূর্যোদয়ের সাথে সাথে হাতে তুলে নেওয়া হয় এবং সেগুলো থেকে তৈরি হয় সুগন্ধি তেল ও গোলাপ জল, যা মক্কার কাবা শরীফের দেয়াল ধোয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়াটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে, যা তায়েফের মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

গোলাপের মহোৎসব কিতাফ:

প্রতি বছর তায়েফে অনুষ্ঠিত হয় ‘কিতাফ’ নামক গোলাপ উৎসব, যা স্থানীয়দের জন্য একটি বড় আনন্দের উপলক্ষ্য। এই উৎসবে ৫০টিরও বেশি লাইভ পারফরম্যান্স, লোকনৃত্য, জল ও আলোর প্রদর্শনী শিশুদের জন্য খেলার জোন এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের গোলাপ ও গোলাপের তৈরী পণ্যের স্টল থাকে।

বুনো গোলাপ দিয়ে সুগন্ধি বানাচ্ছে একজন মানুষ, ছবি: এএফপি

উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হলো একটি বিশাল ফুলের কার্পেট, যা ৫,২০৬ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং এতে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি গোলাপ ও ফুল ব্যবহার করা হয়। এই কার্পেটের নঁকশা তায়েফের ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদ ও স্থাপত্যশৈলী থেকে অনুপ্রাণিত।

জলবায়ুর প্রভাব:

তায়েফের গোলাপ চাষ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মুখোমুখি। অপ্রত্যাশিত ঠান্ডা, অতিরিক্ত গরম এবং অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত গোলাপের উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। তবে স্থানীয় চাষিরা তাদের ঐতিহ্য রক্ষার্থে নিজেদের শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন।

জীবনের অধিকাংশ সময় গোলাপ চাষে কাটিয়েছেন খালাফ আল্লাহ আল-তালহি (৮০) । তিনি বলেন, “এই বাগান আমার আত্মা ও হৃদয়ের স্পন্দন। আল্লাহ চাইলে মৃত্যু ছাড়া কিছুই আমাকে এটি থেকে আলাদা করতে পারবে না।”

সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি:

তায়েফের গোলাপ শুধু একটি ফুল নয়; এটি একটি সংস্কৃতি, একটি ইতিহাস ও একটি জীবন্ত ঐতিহ্য। এই গোলাপগুলো প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও মানুষের ভালোবাসা একত্রে একটি সমাজকে কিভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে তা প্রতিনিয়ত শিখিয়ে যাচ্ছে।

তায়েফের গোলাপের গল্প মরুভূমির বুকেও ফুল ফোটে; যদি সেখানে ভালোবাসা, যত্ন ও ঐতিহ্যের স্নেহ থাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয়। 

খালাফ আল্লাহ আল-তালহি গাছের ডাল থেকে একটি গোলাপ তুলে নিচ্ছেন, ছবি: এএফপি

সৌন্দর্য সবসময় চোখে দেখা যায় না:

সৌন্দর্য সবসময় চোখে দেখা যায় না। তা অনেক সময় অনূভবে, সুবাসে ও ঐতিহ্যের নীরব দ্যুতিতে প্রকাশ পায়। মরুভূমির কঠোরতা যখন জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে, তখন তায়েফের গোলাপ যেন সেই বাস্তবতার মাঝে এক নরম ও কোমল প্রতিবাদ, যা সৌন্দর্যের এক চিরন্তন দিক রক্ষা করে চলেছে।

তাই বলা যায়, এই শহর শুধু ফুলে নয়। এটি সুগন্ধে, স্মৃতিতে ও সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ। তায়েফের প্রতিটি গোলাপ যেন ইতিহাসের এক এক পাতা,যা বলছে আরব জনপদের এক অজানা কবিতার গল্প। যেখানে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের ঘ্রাণে গড়ে উঠেছে এক অনন্য মরুদ্যান।

অনুবাদ: জালাল উদ্দিন, সূত্র: এএফপি ও জিও নিউজ