ডোনাল্ড ট্রাম্পের মা, ম্যারি অ্যান ম্যাকলাওডের জন্ম স্কটল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের লুইস দ্বীপের একটি ছোট গ্রাম টং-এ, ১৯১২ সালে। বাবা মালকম ম্যাকলাওড একজন পোস্ট মাস্টার ও দোকানদার ছিলেন।
পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল গড়পড়তা থেকে একটু ভালো, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ওই অঞ্চলের জীবন অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে।
তাদের পরিবারে ছিল ১০ ভাই-বোন। অনেকেই সে সময় কাজের খোঁজে স্কটল্যান্ড ছেড়ে কানাডা বা আমেরিকায় যাচ্ছিলেন। সেই ধারা অনুসরণ করে, ১৮ বছর বয়সে ১৯৩০ সালে, ম্যারি অ্যান নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমান, বোন ক্যাথরিনের সঙ্গে।
সেখানে গৃহপরিচারিকার কাজ শুরু করলেও, মার্কিন অর্থনীতির মন্দার কারণে চাকরি হারিয়ে কিছু সময়ের জন্য আবার স্কটল্যান্ড ফিরে যান।

কিন্তু এর মধ্যেই নিউ ইয়র্কে তার পরিচয় হয় ফ্রেড ট্রাম্পের সঙ্গে। তখন ফ্রেড একজন উদীয়মান রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী, যিনি জার্মান অভিবাসী পরিবারের সন্তান। ১৯৩৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। পরে তারা নিউ ইয়র্কের কুইন্সে স্থায়ী হন।
এরপর তাদের ঘর আলো করে আসে পাঁচ সন্তান। চতুর্থ সন্তান ছিলেন ‘জন ডোনাল্ড’ যিনি পরবর্তীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।
ম্যারি অ্যান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন ১৯৪২ সালে। কিন্তু স্কটল্যান্ডের লুইস দ্বীপের সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনোই বিচ্ছিন্ন হয়নি। তিনি স্কটল্যান্ডের গ্যালিক ভাষায় কথা বলতে পারতেন এবং প্রায়ই দেশে ফিরে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতেন। স্থানীয়রা তাঁকে একজন পরিচিত এবং সম্মানিত মুখ হিসেবেই চিনতো।
বংশানুসন্ধানকারী বিল লসনের গবেষণা অনুযায়ী, ম্যারি অ্যানের মা বাবার পারিবারিক ইতিহাসে রয়েছে দুই ধরনের বড় পরিবর্তন। একদিকে ছিল মাছ ধরার সময় প্রাণহানির ঘটনা, অন্যদিকে ছিল হাইল্যান্ড ক্লিয়ারেন্স-এর প্রভাব, অর্থাৎ ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও স্থানান্তর।

ম্যারি অ্যানের পিতৃপুরুষদের মধ্যে ছিলেন আলেকজান্ডার রয় ম্যাকলাওড (দাদা) এবং তাঁর ছেলে মালকম (বাবা)। ধারণা করা হয় ১৮৫০ এর দশকে ঝড়ের মধ্যে মাছ ধরতে গিয়ে দুজনেই প্রাণ হারিয়েছিলেন।
এরকম দুর্ঘটনা লুইস দ্বীপসহ স্কটল্যান্ডের উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, এবং ছোট নৌকায় যাত্রা করায় প্রায়ই ঘটত বিপর্যয়। এসব দুর্ঘটনায় পরিবারগুলো যেমন রোজগারের উৎস হারাত, তেমনি অনেকে হয়ে যেতেন বিধবা বা এতিম। ম্যারি অ্যানের পরিবারেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
ম্যারি অ্যানের মায়ের দিকের পরিবার স্মিথরা ছিল সাউথ লক্স এলাকার বাসিন্দা। ১৮২৬ সালে তারা উচ্ছেদের শিকার হন। যদিও মূলত হাইল্যান্ড ক্লিয়ারেন্স নামে পরিচিত উচ্ছেদপ্রক্রিয়াগুলো স্কটল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডে বেশি ঘটেছিল, তবে ওয়াটারলুর যুদ্ধের (১৮১৫) পরপরই লুইস দ্বীপেও চাষযোগ্য জমিগুলোকে বাণিজ্যিক ভেড়া চাষের জন্য প্রস্তুত করতে অনেক কৃষক পরিবারকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

তবে অন্য জায়গার মতো পুরোপুরি দ্বীপ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। বেশিরভাগ পরিবারকে দ্বীপের অন্য অংশে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। ম্যারি অ্যানের পূর্বপুরুষদেরও মূল বসতবাড়ি থেকে সরিয়ে স্টোর্নোওয়ে পারিশ এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়।
এইসব পরিবর্তনের কারণে ম্যারি অ্যানের পরিবারের একাধিক প্রজন্মকে দ্বীপের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হতে হয়।
২০০০ সালে ম্যারি অ্যান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০০৮ সালে একবার টং গ্রামে যান এবং তাঁর মায়ের শৈশবের বাড়ি দেখেন। যদিও তিনি সেখানে খুব অল্প সময় ছিলেন, এ সফর ছিল তাঁর পারিবারিক শিকড়ের সঙ্গে পুনঃসংযোগের একটি সুযোগ।
স্কটল্যান্ডে ঝটিকা সফরে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মায়ের পৈতৃক বাড়িতে মাত্র ৯৭ সেকেন্ড সময় কাটিয়েছিলেন।
তখন তিনি বলেন, ‘আমি খুব ব্যস্ত, সারা বিশ্বে কর্মসংস্থান তৈরির কাজ করছি, তাই ফিরে আসার সময় বের করা খুব কঠিন। তবে এবারটা যথাযথ সময় মনে হয়েছে, কারণ আমার নিজের প্লেন আছে। আমি খুশি যে এসেছি, আবারও আসব।’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় বোন ম্যারিয়ান ট্রাম্প ব্যারি, একজন ফেডারেল বিচারক ছিলেন। ব্যারি লুইস দ্বীপে আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। স্থানীয়দের মতে, তিনি ছিলেন পরিবারের সেই সদস্য, যিনি দ্বীপটির সঙ্গে বাস্তবিক সম্পর্ক ধরে রেখেছিলেন।
ছবি ও তথ্য : বিবিসি