হালের অভিভাবকত্বের নতুন ধারা ‘জেন্টল প্যারেন্টিং’। একটা সময় ছিল, যখন বাড়ির ছোটরা বড়দের সামনে কথা বললে চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দেওয়া হত। প্রশ্ন করলেই কপালে জুটত বকুনি, অনেক সময় উত্তম মধ্যম।
এমন স্মৃতি অনেকেই এখনো বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখেন। ফলে শিশুর কৌতূহল আর সাহস দুইটাই একসঙ্গে চুপ হয়ে যেত।
অনেকের শৈশব কেটেছে শাসনের ভয় আর চুপচাপ শিখে নেওয়ায়। ভালো হওয়ার মানে ছিল ভয় পাওয়া, নিয়ম মানা ও প্রশ্ন না করা। কিন্তু সময় বদলেছে। বদলেছে অভিভাবকত্বের ভাষা।
আজকের অনেক বাবা-মা বলছেন, আমার সন্তান যেন বড় হয় নিজের মতো, ভয় নয়-ভালোবাসায়। এই ভাবনা থেকেই উঠে এসেছে এক নতুন ধারা জেন্টল প্যারেন্টিং।
অনেকেই ভাবেন জেন্টল প্যারেন্টিং মানেই বুঝি সবকিছুতে হ্যাঁ বলা। শিশুকে মাথায় তুলে রাখা, কোনোরকম ‘না’ না বলা। কিন্তু এটা ভুল।
এই ধারার মূল কথা হল ভালোবাসা আর শৃঙ্খলা, দুইটি হাত ধরাধরি করে চলবে। না থাকবে ভয়, না থাকবে অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা।

এই প্রসঙ্গে মার্কিন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডা. ব্রায়ান রাজ্জিনো বলেন, ‘জেন্টল প্যারেন্টিং মানে শিশুর অনুভূতিকে সম্মান করা, তার ভুলকে সুযোগ হিসেবে দেখা, আর ভালোবাসা দিয়ে তাকে দায়িত্ববোধ শেখানো।’
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, প্যারেন্টিংয়ের চারটি ধরন রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-
১. নির্লিপ্ত বাবা-মা : যারা সন্তানের চাহিদা বা আবেগে মনোযোগ দেন না।
২. কঠোর বাবা-মা : যারা মনে করেন শাসনই সবকিছু, কোনো যুক্তি বা সংলাপের সুযোগ নেই।
৩. অতিরিক্ত ছাড় দেওয়া বাবা-মা : যাদের ভালোবাসা আছে, কিন্তু সীমাবদ্ধতা নেই।
৪. নির্ভরযোগ্য বাবা-মা : যারা ভালোবাসা ও নিয়ম দুটোর মধ্যেই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেন।
জেন্টল প্যারেন্টিং আসলে চতুর্থ ধরনটিরই একটি মানবিক ও আধুনিক রূপ। যেখানে শিশুকে বলা হয়, তোমার অনুভূতি আমি বুঝি, কিন্তু কাজের পরিণতি কী, সেটাও বুঝতে শেখো।
ধরা যাক- আপনার তিন বছরের ছেলে খেলতে খেলতে প্লেট থেকে খাবার ছুঁড়ে ফেলল। আপনি কী করবেন?
কঠোর বাবা-মা বলেন, ‘তোমার খাওয়া শেষ! এখনই ঘরে যাও। সব কিছুতে হ্যা বলা বাবা-মায়েরা হয়তো বলেই ফেলেন, ও তো ছোট! সমস্যা নেই।’
অপরদিকে জেন্টল অভিভাবক বলেন, ‘তুমি হয়তো খেলতে চাইছো, কিন্তু খাবার ছোঁড়া ঠিক না। আবার করলে প্লেটটা সরিয়ে ফেলব।’ এখানে আছে সহানুভূতি, স্পষ্টতা ও বাস্তব প্রতিক্রিয়া সবকিছু একসঙ্গে।

এক জরিপ বলছে, বর্তমান প্রজন্মের প্রায় অর্ধেক বাবা-মা চান তাদের সন্তান যেন নিজের মতো বড় হয়। ভয় নয় বরং ভালোবাসায়।
তারা চায় সন্তান খোলামেলা কথা বলুক, নিজের আবেগ বুঝুক, সমাজে আত্মবিশ্বাসীভাবে চলুক।
এই চিন্তা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও জেন্টল প্যারেন্টিং ধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেক অভিভাবকই শেয়ার করছেন নিজেদের গল্প।
২০২২ সালের এক গবেষণা বলছে, জেন্টল প্যারেন্টিংয়ে বড় হওয়া শিশুরা পড়াশোনায় বেশি সফল।
একই বছর আরেক গবেষণা জানায়, যেসব পরিবারে এভাবে প্যারেন্টিং হয় না, সেসব শিশুর জীবনসন্তুষ্টির হার কম।
তাই প্রতিদিনের ক্লান্তির মধ্যেও ধৈর্য রাখা, রাগ চেপে রাখা, বারবার ব্যাখ্যা দেওয়া, ভুল হলেও শান্তভাবে শেখানো শিশুর জন্য আদর্শ। বিশেষ করে যখন নিজের শৈশব ছিল শাসনের মাঝে, তখন এই পরিবর্তনটা আরও কঠিন।
গবেষক অ্যানি পেজাল্লা বলেন, ‘অনেক অভিভাবক এতটাই চেষ্টা করেন সব ঠিক রাখতে, যে নিজেরাই মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাই নিজেকে ছাড় দেয়াও শেখা জরুরি।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘কিছু মূল বিষয় মাথায় রাখলে জেন্টল প্যারেন্টিং সহজ হতে পারে।’
রুটিন ও সীমা প্রতিদিনের নিয়ম শিশুকে নিরাপত্তা দেয়। ভালোবাসা ও মনোযোগ, আলিঙ্গন, চোখে চোখ রেখে কথা এসবই আবেগ বোঝার ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দেয়া তুমি যেমন, আমি তা বুঝি —এই বার্তা খুব জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি আজকের ছোট শিক্ষা ভবিষ্যতের বড় ভিত।

নিখুঁত না, মানবিক হন
ডা. নিকোল জনসন বলেন, ‘আপনার সন্তান চায় না আপনি নিখুঁত হোন। সে দেখতে চায় আপনি কিভাবে ভুল স্বীকার করেন, নিজেকে সামলান, আর আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করেন। এই শেখাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। শিশু মানুষ হয় দেখে, শুনে। শুধুই বলে দেওয়া নিয়মে নয়।’
জেন্টল প্যারেন্টিং মানে শিশুকে শুধু বড় করা নয়। নিজেকেও নতুনভাবে গড়ার এক পথ। এই পথে ভয় নেই, চিৎকার নেই, আছে শ্রদ্ধা। আর আছে এমন এক বন্ধন, যেখানে বাবা-মা আর সন্তান একসঙ্গে বড় হন—দায়িত্বে, ভালোবাসায় ও মনুষ্যত্বে। আপনার সন্তানের হাত ধরে হাঁটুন। সে যেমন শেখে, আপনিও শিখবেন কীভাবে একজন মানুষ হয়ে ওঠা যায়।
সূত্র : সিএনএন