রঙিন বাড়ির শহর বো-কাপ 

দক্ষিণ আফ্রিকার ঐতিহাসিক এক স্থানের নাম বো-কাপ। দেশটির বিধানিক রাজধানী কেপটাউন শহরের অদূরে সিগন্যাল পাহাড়ের কোল ঘেষে দাড়িয়ে আছে বো কাপ।

এখানে রয়েছে ২৬০ বছরের নিদর্শন ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। সারি সারি হরেক রঙের ভবন আর খোয়া পাথরের দৃষ্টিনন্দন পথের জন্য বো কাপ বিখ্যাত।

ওলন্দাজ উপনিবেশিক আমলে ১৭৬০ সালের শেষের দিকে বো কাপে জমি কিনেছিলেন ইয়ান দে ভাল নামে একজন ওলন্দাজ। এক বছর পর দে ভালের ভূ-সম্পত্তি প্রসারিত হতে থাকে।

এটি এক সময় মালয় কোয়ার্টার নামে পরিচিতি পায়। এর আগে এলাকাটি ভালের নামানুসারে ভালেন ড্রপ নামে পরিচিত ছিল।

১৭৬৩ সালে ইয়ান ভাল এখানে একতলা ভাড়া ঘর নির্মাণ করে নিজের ক্রীতদাসদের কাছে বরাদ্দ দিতে শুরু করেন। ‘কেপ মালয়েশ’ নামে পরিচিত এই ক্রীতদাসদের বেশিরভাগই মালয়েশিয়ান ও ইন্দোনেশিয়ান।

বাকিদের আফ্রিকার অন্যান্য অংশ থেকে কাজের উদ্দেশে কেপটাউনে আনা হয়েছিল। মূলত এজন্যই ‘মালয়’ নামের উৎপত্তি।

কেপটাউন সিটি সেন্টার ও ডি ওয়াটারকান্ট থেকে দশ মিনিট ও ভিঅ্যান্ডএ ওয়াটারফ্রন্ট থেকে ২০ মিনিটে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়।

গোলাপি, কমলা, চুন-সবুজ, বেগুনি, ফিরোজা, হলুদ, বাদামি, নীলসহ সারিবদ্ধ রঙিন ভবনগুলো বো কাপের অন্যতম আকর্ষণ।

তবে ভবনগুলো বর্তমানে বাহারি রঙে সজ্জিত করা হলেও অতীতে এমন ছিল না। অতীতে জমি লিজ গ্রহণের সময় সব বাড়ির রঙ সাদা হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল।

তবে ১৮৩৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসরা ফিরে এসে এখানকার জমি কেনার অনুমতি পায়। এরপর বাড়ির রঙ সাদা হওয়ার নিয়মটি বাতিল হয়।

বো কাপ এর সারি সারি রঙ্গিন বাড়ি

স্বাধীনতার প্রকাশের অংশ হিসেবে রঙের এই প্রতীকী চর্চা শুরু হয়েছিল, যা ১৮০ বছর ধরে চলমান রয়েছে।

বো কাপে বেশির ভাগ বাড়িই একতলা, যা ১৭৯০ থেকে ১৮২৫ সালের মধ্যে কেপ ওলন্দাজ এবং কেপ জর্জিয়া স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে নির্মিত।

তবে আঠারো শতকের প্রথম দশকে কিছু বাড়িতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক কারণে ব্রিটিশ শৈলী নজরে পড়ে।

বো-কাপের অন্যতম আকর্ষণ খোয়া পাথরের রাস্তা। ওলন্দাজ উপনিবেশকালে তৎকালীন হল্যান্ড বর্তমানে নেদারল্যান্ডস থেকে এসব পাথর আফ্রিকায় আমদানি করা হয়।

খোয়া পাথরগুলো ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধতা থেকে বো-কাপবাসীদের সুরক্ষা দেয়। বো-কাপের প্রায় সব রাস্তায় ম্যুরাল দেখা যায়। যেগুলোতে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সংমিশ্রণ ফুটে আছে।

এখানকার প্রাচীনতম বাড়িটি বর্তমানে বো-কাপ জাদুঘর। সংরক্ষিত আছে ঊনিশ শতকের গৃহসজ্জা সামগ্রী।

বাড়িটির পেছনে গাছ ও দ্রাক্ষালতা বেষ্টিত খোয়া পাথরের ছোট আঙিনা সরু গলির মাধ্যমে রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত। সপ্তাহের সোম থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকে।

প্রায় দশ হাজার মানুষের বসতি রয়েছে বো কাপে। রয়েছে বিভিন্ন নামে কয়েক ডজন স্ট্রিট। ঐতিহ্যগতভাবে এলাকাটি বহু সংস্কৃতির অংশ হলেও এর জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলিম।

১৮২০ সালের দিকে জাভা ও সিলন থেকে রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত মুসলিমরা এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম মসজিদটিও বো কাপে অবস্থিত,যা আউয়াল মসজিদ নামে পরিচিত।

ইন্দোনেশীয় যুবরাজ ও তুয়ান গুরু আবদুল্লাহ ইবনে কাদি আল-সালাম ১২ বছর আফ্রিকার রোবেন দ্বীপে বন্দি থাকার পর মুক্ত হয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন।

পাহাড়ের পাদদেশে বোক-আপ শহর

ড্রপ স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে অবস্থিত এই মসজিদটিতে আল সালামই প্রথম ইমাম ছিলেন। পরবর্তীতে মাদ্রাসা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।

ইসলামের স্বীকৃতি ও উপাসনার স্বাধীনতার জন্য কেপ মুসলিমদের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবেও মসজিদটি বিবেচিত।

এছাড়াও লং স্ট্রিটে রয়েছে আঠারো শতকে নির্মিত পাম ট্রি মসজিদ। এর সামনে শতবর্ষী দৃষ্টিনন্দন পাম গাছের জন্যই এমন নাম মসজিদটির।

বুয়েটেনগ্র্যাচ স্ট্রিটে রয়েছে প্রাচীনতম নুরুল ইসলাম মসজিদ। তুয়ান গুরুর ছেলে আবদুল রউফ ১৮৪৪ সালে এটি নির্মাণ করেন।

এছাড়াও খিয়াপিনি, হেলিগার ও লং স্ট্রিটসহ বিভিন্ন স্ট্রিটে রয়েছে প্রায় ডজন খানেক মসজিদ।

বো-কাপের একটি গুরুত্ববহ স্থান তানা বারু। এটি কেপ মুসলমানদের নির্মিত প্রথম সমাধিস্থল। তুয়ান গুরুর সমাধিসহ দক্ষিণ আফ্রিকার সম্মানিত মুসলিম বাসিন্দার কয়েকজনের সমাধি রয়েছে এতে।

বাহারি ও মন জুড়ানো নকশার পোশাক, হাতে তৈরি গহনা, উট পাখির চামড়ার হাতব্যাগ, জুতা, ব্রোঞ্জের মূর্তিসহ হস্তশিল্পের সরবরাহ মেলে এখানে।

রেস্তোঁরাগুলোতে হালাল ও অ্যালকোহল মুক্ত খাবার পরিবেশন করা হয়। ফল, সবজি ও মাংস মিশ্রিত কেপ মালয় খাবারের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। কেপ মালয় খাবার মূলত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার রন্ধনশৈলীর মিশ্রণ।

কেক, সমুসা, কুইস্টার, জ্যাম কফি, ব্রিডিজ, কারি ও বোবোটি ছাড়াও প্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত হলুদ, জাফরান, মরিচ ও মসলার সমাহার দেখা যায় বো কাপে।

কেপটাউন আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় সাড়ে ২১ কিলোমিটার দূরবর্তী বো-কাপে বাস, ট্যাক্সি বা রাইড শেয়ারিং যোগে যাওয়া যায়।

এজন্য লাগে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা। রাতযাপনের জন্য এখানে আছে তিন, চার ও পাঁচতারকা মানের আবাসন ব্যবস্থা।