একুশ শতকের অনন্য সৃষ্টি বুর্জ খলিফা

বর্তমান দুনিয়ার এক বিস্ময়কর শহরের নাম দুবাই। একই সঙ্গে এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে জনবহুল, সর্ববৃহৎ ও রাজধানী শহরও।

গগণচুম্বি ভবন, কৃত্রিম দ্বীপ, নামী দামী গাড়ি, বাড়ি, বিলাসবহুল ও অদ্ভুত জীবন যাপনের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত এক শহর।

দুবাই শহরের প্রাণকেন্দ্রেই ২০১০ সালে নির্মাণ করা হয় বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফা, যা স্থাপত্য বিদ্যার অনন্য দৃষ্টান্ত।

রকেট আকৃতির এই ভবনটি ২০৬ তলাবিশিষ্ট। এটি আইফেল টাওয়ারের চেয়েও প্রায় তিনগুণ উঁচু।

এটি এতোই উঁচু যে সূর্যাস্তের পরও প্রায় ২ মিনিট ধরে উপরের তলার মানুষ সূর্য দেখতে পায়। রমজান মাসে সর্বোচ্চ তলার মানুষ ইফতারি করেন নিচ তলায় থাকা মানুষের দুই মিনিট পর।

উচ্চতা ছাড়াও বুর্জ খলিফার শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে রয়েছে অনেকগুলো বিশ্বরেকর্ড ও মনোমুগ্ধকর নির্মাণকৌশল।

আরবি বুর্জ অর্থ টাওয়ার। নির্মাণের সময় ‘বুর্জ দুবাই’ এর নামকরণ হলেও উদ্বোধনের সময় এর নাম পরিবর্তন করে বুর্জ খলিফা রাখা হয়। ভবনটির আরেক নাম দুবাই টাওয়ার।

বিশ্বের সুউচ্চ এই ভবনটি নির্মাণকাজ ২০০৪ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর। আর উদ্বোধন হয় ২০১০ সালে।

আকাশছোঁয়া এই ভবনটির প্রধান স্থপতি ছিলেন আদ্রিয়ান স্মিথ। আর প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন সুফিয়ান আল জাবিরি। এছাড়া ৩৮০ জন দক্ষ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ এর নির্মাণ কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।

ভবনটিতে বাংলাদেশি বংশভূত প্রখ্যাত স্থপতি ফজলুর রহমান খানের আবিষ্কৃত ‘বান্ডেল টিউব’পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়,

যার ফলে সুবিশাল এই ভবনে মাত্র ৪ হাজার টন লোহা ব্যবহার করেই নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। ভবনের নকশাটি নবম শতকে নির্মিত ইরাকের সর্পিলাকার একটি মসজিদের আদলে করা হয়।

সর্পিলাকৃতির নকশা করার কারণ ঘূর্ণিঝড় সহনশীলতা বাড়ানো। দুবাই ধূলিঝড় প্রবণ শহর হওয়ায় প্রচণ্ড ধূলিঝড় থেকে সর্পিলাকৃতি কাঠামো বিল্ডিংকে অধিক সহনশীল করেছে।

অভ্যন্তরীণ তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত জানালার কাঁচে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যার ফলে বাহিরে প্রচণ্ড উত্তাপ থাকলেও অভ্যন্তরে থাকে স্বাভাবিক তাপমাত্রা।

ভবনের অভ্যন্তরীণ নির্মাণশৈলী বাহিরের চেয়ে অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর ও আকর্ষণীয়। বাছাইকৃত ১ হাজার চিত্রকর্ম দিয়ে ভবনের অভ্যন্তর সাজানো হয়।

১ লাখ ৭৪ হাজার বর্গ মিটার দেয়ালজুড়ে রয়েছে বিশালাকার ২৬ হাজার শক্ত প্রতিসারক কাঁচ ও এলুমিনিয়ামের পাত।

বুর্জ খলিফার বাইরের পার্ক ও ঝর্নায় মনোরম পরিবেশ বজায় রাখা হয়েছে। মূল প্রবেশ পথেই রয়েছে নীলাভ পানির একটি ঝর্না।

৬ হাজার ৬০০ টি রঙিন বাতি দ্বারা রাতে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করে এই কৃত্রিম ঝর্ণা। ভবনের চার পাশে রয়েছে পাম গাছের মতো এক ধরনের মরু উদ্ভিদ পার্ক ,যা এর সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

বুর্জ খলিফা একইসঙ্গে একটি সাত তারকা হোটেল, মসজিদ, বিনোদন কেন্দ্র, নাইট ক্লাব, এ্যাপার্টমেন্ট, অফিস এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণ ডেক হিসেবে বিখ্যাত। এ ভবনে ঘণ্টায় ৪০ মাইল গতি বেগে চলে এমন মোট ৫৪টি এলিভেটর আছে, যা বিশ্বের দীর্ঘতম ও দ্রুততম এলিভেটর।

এছাড়া যাদের নিজস্ব হেলিকপ্টার রয়েছে, তাদের জন্য রয়েছে হেলিপ্যাড ব্যবস্থা। পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে এই ভবনে। বিশ্বের উচ্চতম সুইমিংপুলও রয়েছে বুর্জ খলিফায়।

পর্যটকদের কাছে এটি সবচেয়ে দর্শনীয় এবং আকর্ষণীয় স্থান। শুধু উচ্চতাই নয়, বুর্জ খলিফার আভিজাত্য এবং চোখ ধাঁধানো নির্মাণশৈলী এক মুহূর্তেই যে কাউকে বিমোহিত করবে।

রাতের বুর্জ খলিফাতে লেজার শো মনে রাখার মতো। আর দুবাই ফাউন্টেইনের ওয়াটার শো তো আছেই। ফাউন্টেইনে পানির বিচিত্র খেলা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এটিই পৃথিবীর সব থেকে বড় ফাউনন্টেইন।

এখানকার বিশাল কৃত্রিম ওয়াটার ডান্স প্রায় সাড়ে ছয় হাজার সঙ্গীতের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৩ থেকে ৬ মিনিট ধরে নৃত্য পরিবেশন করে।

সন্ধ্যায় এই ফাউন্টেইনে যুক্ত হয় ৬ হাজার ৬০০টি সুপার লাইট এবং ২৫টি রঙের প্রজেক্টর, যা পানির ধারাকে বহুরূপে প্রকাশ করে।

রঙিন আলোকরশ্মির ঝলমলে আলো ২০ মাইলেরও বেশিদূর থেকেও দেখা যায়। প্রতি ১৫-২০ মিনিট অন্তর এই ওয়াটার ডান্স দেখা যায়। হাজার হাজার পর্যটক দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য উপভোগ করে।

জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতির চরম শিখরে আরোহনের পর গত কয়েক শতাব্দীতে পৃথিবীর সপ্তার্য পিরামিডের উচ্চতার রেকর্ডকে ভাঙ্গতে সক্ষম হয়।

১৮৮৯ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আইফেল টাওয়ার নির্মাণের পর পিরামিড তার উচ্চতার গৌরব হারায়।

অন্যদিকে বুর্জ খলিফা একুশ শতকের এক বিস্ময়কর ও অনন্য সৃষ্টি। হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে উচ্চতম স্থাপত্য কর্ম হিসেবে স্থান করে নেয়।

বুর্জ খলিফার বিস্ময়কর কাঠামো ও বৈচিত্র্য মানুষকে প্রতিনিয়ধ টানছে। অত্যাধুনিক এই কাঠামোতে প্রযুক্তির উৎকর্ষ চমৎকৃত করে যাচ্ছে ভ্রমণপিপাসুদের।