চারপাশে যখন নির্বিচারে গাছ কেটে বন উজাড়ের মহোৎসব চলছে, তখনই ‘বন কাগজ’ আবিস্কার করে সবুজ বনায়নের বার্তা নিয়ে ছুটছেন সুমন ও তার ‘শালবৃক্ষ’ দল। এরই মধ্যে এই ‘বন কাগজ’ জনপ্রিয় উঠেছে বিভিন্ন মহলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে।
দেশে তৈরি করা কাগজটা সুন্দরবন আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় পরিবেশের জন্য ভাল কিছু করার তাড়না থেকে বানানো। অনেকেই বলেছেন এটা আগেই ছিল। নতুন আর কি। তাদের জন্য এই নিবন্ধটি।
কাগজ থেকে উৎপাদন হবে গাছ এ ধারণা বেশ পুরোনো। যা আমেরিকা, জার্মানি, ভারত, জাপানে আগে থেকেই ছিল সেটাকে বলা হয় সিড পেপার। ওয়েস্টার্নদের সিড পেপার আর বাংলাদেশে তৈরি করা বনকাগজের পার্থক্য আছে। বনকাগজ তার স্বতন্ত্রতায় উজ্জল।
সিড পেপারে খুব বেশি হলে দুই জাতের গাছ উঠে আর সেটা ফ্যাশনেবল লাক্সারি প্রোডাক্ট। যা বিশেষ করে ডেকোরেশনে ব্যবহার করা হয়। সিড পেপার থেকে খাদ্য, কর্মসংস্থান, মাটি, পরিবেশের জন্য কিছু করার কথা ভেবে তৈরি করা হয়নি, তার প্রয়োজনও ছিল না। সিড পেপার বানানো খুব কঠিনও না।
পক্ষান্তরে বন কাগজ খাদ্য উৎপাদনকে লক্ষ করে বানানো। যদি খুব সামান্য পরিমাণও উৎপাদন হয় সেটাই বাড়তি পাওয়া। সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হবে। আর বন কাগজ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যা দিয়ে পারমা কালচার কৃষি চর্চা করা যাবে।

পারমা কালচারে মাটির উপকার হয়। মাটি প্রাণ ফিরে পায়। তাতে বাড়তি সার, কিটনাশক তেমন দিতে হয় না। এর ফলে পাওয়া যায় নিরাপদ ফসল আর প্রকারান্তরে উপকৃত হয় পরিবেশ। উপকৃত হয় পাখি, প্রজাপতি, মৌমাছি, ব্যাঙ, কেঁচো, অনুজীব, উপজীব সবাই।
সিড পেপার দিয়ে পারমা কালচার সম্ভব না হলেও বন কাগজ দিয়ে তা সম্ভব। এখানেই এর স্বকীয়তা। আর কাগজটা বানানো কষ্টকর ও সময় সাপেক্ষও বটে।
শালবৃক্ষ টিম বন কাগজ এর নেপথ্যে কাজ করছে। সবার ভালবাসা আর আস্থার প্রতিদান দিতে চায় পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশি এ টিমটি। শীঘ্রই আরো কয়েক ধরণের পরিবেশবান্ধব লাইফস্টাইল প্রোডাক্ট উপহার দিতে পারবে তারা।
যেকোনো একটা নতুন উদ্যোগ সদ্য জন্মানো শিশুর মতো। বন কাগজ আজকে শিশু। তার বিকাশ সাধনে প্রয়োজন যথোপযুক্ত পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতা। তাহলেই উদ্যোগটা বড় হবে। সাধারণের কাছে ন্যায্য মূল্যে জিনিসটা ঘরে ঘরে পৌছে দেয়া যাবে। সে লক্ষ অর্জনের জন্য সবার ভালবাসা, সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার।

ভিজিটিং কার্ড, লিফলেট ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র কাজ শেষে সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়। তখন তা হয়ে যায় বর্জ্য কাগজ। তবে সেই বর্জ্য কাগজ থেকে যদি গাছ জন্মায় তাহলে তো দারুণ হয়।
বিষয়টি অকল্পনীয় বা অসম্ভাব্য মনে হলেও বাস্তবে ফেলে দেওয়া এসব কার্ড থেকে গাছ জন্মানোর অভাবনীয় প্রকল্প উদ্ভাবন করেছেন নারায়ণগঞ্জের ছেলে প্রকৌশলী মাহবুব সুমন।
তার অভিনব উদ্ভাবন নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস-ই হবে না। কাগজে তৈরি ভিজিটিং কার্ড বা যে কোনো ধরনের আমন্ত্রণপত্র মাটিতে ফেললেই একটি বা দুটি নয় বিভিন্ন জাতের ১১ ধরনের সবজি ও ফুলের গাছ জন্মাবে।
শুধু তাই নয় পরিবেশ প্রেমী সুমনের ঘরে রয়েছে বাঁশের তৈরি জগ, জৈব সার তৈরির নানা পরিবেশবান্ধব সামগ্রী। পরিবেশ রক্ষার কথা মাথায় রেখে দীর্ঘদিনের গবেষণা ও পরীক্ষা শেষে এ আবিষ্কার বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘শালবৃক্ষ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ রয়েছে এ বন কাগজের। ইতিমধ্যে সুদূর আামেরিকা থেকে বন কাগজের একটি অর্ডারও দিয়েছেন একজন। সরকারি উদ্যোগ বা সহযোগিতা পেলে এ বন কাগজ হয়ে উঠতে পারে পরিবেশ রক্ষার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবুল খায়েরের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সুমন মেজো ছেলে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার প্রাইভেট ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটিতে।
সেখান থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি প্রকৌশলী ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট। এর আগে সৌরবিদ্যুৎ, বায়োবিদ্যুৎ, বায়োপ্লাস্টিক ও সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেছেন।
কাগজের জন্ম গাছ থেকে, আবার কাগজকে কীভাবে পুনরায় গাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায় এ পরিকল্পনা আসে তার মাথায়।

সে ক্ষেত্রে গবেষণা শুরু করে এ বর্জ্য কাগজকে কীভাবে পরিবেশ রক্ষার সম্পদে পরিণত করা যায়। বন কাগজ তৈরির কাজটি অনেক কঠিন।
এ কাগজটি মাটিতে ফেলে দিলে সেখান থেকে জন্মাবে ১১ রকমের ফসল! প্রায় এক বছরের প্রচেষ্টার পর জনসমক্ষে বন কাগজ সামনে এনেছে সুমন ও তার দল। এ বন কাগজ তৈরির আইডিয়া, গবেষণা, পরীক্ষাসহ কাজটি সফলভাবে শেষ করে আনতে এক বছর সময় লেগেছে।
বন কাগজে ৮ রকমের সবজি, ফল আর ৩ রকমের ফুলের বীজ আছে। রোপণের বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। মাটির ওপর পুরো কাগজটি বা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলে দিলেই হলো।
সেই মাটিতে যদি পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকে তাহলে ৮-৯ দিনের মধ্যে গাছ দেখা যাবে। আর মাটি আর্দ্র না হলে কাগজটাকে মাটির ওপর রেখে একটু ভিজিয়ে দিলেই হয়। জমিতে যেমন সবজির বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয় সেভাবে দিলেই হবে।
ওপর থেকেই আলো, বাতাস আর পানির সাহায্যে এটাতে অঙ্কুরোদ্গম হয় এবং পাখি খেয়ে না ফেললে সেটা থেকে গাছ বড় হতে থাকে।
এ বন কাগজ থেকে জন্মাবে বিলাতি ধনিয়াপাতা, লালশাক ও তিন জাতের শাক, পিয়াজ, মরিচ, দুই জাতের টমোটো ও ফুলের মধ্যে মোড়ক ফুল, কসমস, ডেইজি, ডিয়ানথুস ও হেলিক্রিসমাসসহ ১১ জাতের বৃক্ষ।
একটি বন কাগজ এক বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। অর্থাৎ একটি বন কাগজের ভেতরে থাকা বীজ এক বছর পর্যন্ত সতেজ থাকবে। এক বছরের ভেতর এটি মাটিতে ফেললে ফসল হবে।

বনকাগজ মূলত তৈরি হয় পরিত্যক্ত কাগজ থেকে। মেশিনের মাধ্যমে প্রথমে কাগজগুলো টুকরো করে ৪২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়, যাতে কাগজগুলো একেবারে গলে যায়।
তারপর ওই কাগজগুলোর মণ্ড তৈরি করে ফ্রেমে আকার অনুযায়ী বসিয়ে দিতে হয়। পরে বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে বীজগুলো কাগজে দিয়ে দিতে হয়। কাজটি করতে হয় খুবই সতর্কতার সঙ্গে, যাতে বীজগুলো নষ্ট না হয়ে যায়।
বনকাগজ তৈরির ব্যয় সম্পর্কে মাহবুব সুমন জানান, প্রকল্পটি নিয়ে এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই এ মুহূর্তে ব্যয়টা তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রতি পিস কাগজ তৈরিতে ব্যয় হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, যা সাধারণ কাগজ তৈরির প্রায় চার গুণ। তবে এই খরচ অর্ধেকেরও কম করা সম্ভব। শিগগিরই খরচ কমিয়ে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসা যাবে।

এদিকে, শুধু বনকাগজেই থেমে থাকেননি মাহবুব সুমন। পরিবেশকে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত রাখতে তৈরি করেছেন বাঁশের তৈরি জগ ও মগ। তৈরি করেছেন পরিবেশ উপযোগী সার তৈরির যন্ত্রও, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাতাল’। যেখানে দৈনন্দিন পচনশীল বর্জ্য থেকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হবে সার। এই সার ছাদ-কৃষিতে ব্যবহার করা যাবে।
মাহবুব সুমনকে পুরো কাজটিতে নানাভাবে সহায়তা করেছেন সায়দিয়া গুলরুখ, কামরুল হাসান ও ইকরামুনেসা চম্পা। তাদের নিয়েই ‘শালবৃক্ষ’। এই দলের সবার প্রচেষ্টার ফসল এই বন কাগজ।